দৈনিক ৫ কোটি আন্তর্জাতিক কলের খবরই জানে না সরকার
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৩:৫১
আন্তর্জাতিক কল বাণিজ্যে আপাত দৃষ্টিতে কঠোরতা আরোপ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে নৈরাজ্য আরো বেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের গোচরেই, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনুমোদনে ব্যবসা চলে গেছে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। লাভবান হচ্ছে কল আদান-প্রদানে নিয়োজিত বেসরকারি কোম্পানি, বিশেষ করে আইজিডব্লিউগুলো (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটর) ৷
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের আয় বৃদ্ধিতে সরকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বড় ভূমিকা রেখেছে ৷ কলরেট কমিয়ে ও প্রভাবালী আইজিডব্লিউগুলোর গঠিত জোটের অনুমোদন দিয়ে সরকার অপারেটরদেরকে আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন ব্যবসা কুক্ষিগত করতে সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত আড়াই বছরের ব্যবধানে এ খাত থেকে সরকারের আয় কমেছে দৈনিক প্রায় আড়াই কোটি টাকা (৩৩.৬০ শতাংশ)। অন্যদিকে বেসরকারি অপারেটরদের আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি (৬৩ শতাংশ) ৷ এ হিসেবে সরকার বছরে সরকার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুণেছে৷
দেখা যাচ্ছে, বৈধপথে কল টার্মিনেশন কমেছে ফলে সরকারের রাজস্বও কমেছে। কিন্তু অপারেটরদের আয় বেড়েছে ঠিকই।
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কল টার্মিনেশন কমার অর্থ বৈধপথে কলের আগমন হ্রাস পেয়েছে। তবে ওই কল বিকল্প পথে (অবৈধ ভিওআইপি) ঠিকই দেশে আসছে৷তারা বলেছেন, বিটিআরসি’র আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনের তথ্যে সঠিক চিত্র ফুটে ওঠে না। প্রকৃত বিষয়টি আরো ভয়াবহ ৷তাদের মতে, প্রতিদিন চার থেকে ৫ কোটি কল গ্রে মার্কেটের (অবৈধভাবে) মাধ্যমে দেশে আসছে। যা থেকে কোনো রাজস্বই পায় না সরকার।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত এক বছরে গড়ে দৈনিক ৫ কোটি ৩১ লাখ আন্তর্জাতিক কল ট্রার্মিনেশন হয়েছে। এসময় কলপ্রতি রেট ছিল সর্বনিম্ন (ফ্লোররেট) তিন সেন্ট সর্বোচ্চ (সিলিং রেট) সাড়ে তিন সেন্ট। এতে দিনে মোট রাজস্ব আয় হতো ১২ কোটি ৩১ লাখ টাকা । যা থেকে বিটিআরসির নির্ধারিত অংশ হিসেবে সরকার পেতো ৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা । অপারেটরদের অংশে যেতো ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে আইজিডব্লিউ এর আয় দিনে ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ভিএসপি’র (ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার) আয় ৬২ লাখ টাকা, আইসিএক্স এর ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা, মোবাইলফোন অপারেটরের আয় ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
এদিকে অবৈধ পথে কলের আগমন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল টার্মিনেশন রেট কমিয়ে আনে কমিয়ে আনে সরকার । ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিটিআরসির এক নির্দেশনায় প্রতি মিনিটের সর্বনিম্ন রেট (ফ্লোররেট)তিন সেন্ট থেকে দেড় সেন্ট করা হয় । একই সঙ্গে অপারেটরদের সঙ্গে বিটিআরসির রাজস্ব ভাগাভাগির কাঠামো পুনর্নির্ধারণ করা হয়। নতুন নিয়মে কলের পরিমাণ বাড়লেও কমে যায় সরকারের আয় । লাভ হয় মূলত অপারেটরদের, বিশেষ করে আইজিডব্লিউগুলোর আয় বেড়ে যায়। পরীক্ষামূলকভাবে চালু হলেও দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ থেকে ২৩ জুন ২০১৫ পর্যন্ত কল টর্মিনেশনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দিনে গড়ে আন্তর্জাতিক কল এসেছে ১০ কোটি ৮৩ লাখ । দৈনিক মোট রাজস্ব আয় আগের ধাপের চেয়ে (১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত) বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা । তবে বিটিআরসির আয় ১৫.২৮ শতাংশ কমে হয় ৬ কোটি ৭ লাখ টাকা। অন্যাদিকে অপারেটরদের আয় ২৬.৫৪ শতাংশ বেড়ে হয় ৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আইজিডব্লিউ’র দৈনিক আয়ের পরিমাণ হয় ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ভিএসপি’র ৬৩ লাখ টাকা, আইসিএক্স এর ২ কোটি ২০ লাখ টাকা, মোবাইলফোন অপারেটরের ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা । অর্থাৎ সব অপারেটরের আয় বেড়েছে ।
প্রতি কলের দেড় সেন্ট রাজস্ব আয় থেকে ৩৫ শতাংশ বিটিআরসি আর ৬৫ শতাংশ পায় অপারেটররা । এর মধ্যে আইজডব্লিউ পায় ২০ শতাংশ, ভিএসপি পায় ৫ শতাংশ (এর ১০ শতাংশ বিটিআরসির রাজস্ব), আইসিএক্স নেয় ১৭দশমিক৫শতাংশ (এর ৬৫.৭৫ শতাংশ বিটিআরসির পাওনা), এএনএস ২২দশমকি৫ শতাংশ (এর ৫.৫ শতাংশ বিটিআরসিরকে দিতে হয়)।
আগের তিন সেন্ট কলরেটের সময় রাজস্ব ভাগাভাগির এই হার ছিল বিটিআরসি ৫১.৭৫ শতাংশ, আইজিডব্লিউ ১৩.২৫ শতাংশ, আইসিএক্স ১৫ শতাংশ এবং এএনএস (মোবাইল অপারেটর) ২০ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, ‘অবৈধ ভিওআইপি (অনুমোদিত ভাবে বিদেশি কল ব্যবসা) রোধে সরকার বদ্ধপরিকর । এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।’
প্রসঙ্গত, বিদেশ থেকে আসা প্রতিটি কল আইজিডব্লিউর মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করে। এরপর তা আইসিএক্স (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ অপারেটর) এর মাধ্যমে তা সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কাছে যায়, যারা এএনএস (এক্সেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস) নামে পরিচিত। অপারেটর গ্রাহকের কাছে কলটি পৌঁছে দেয়।
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন