হার্টের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য
১৯ মার্চ ২০১৬, ০৮:৩৫
খাদ্যে চর্বি সম্বন্ধে প্রচলিত জ্ঞান ও ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। এক সময় তেল ও চর্বি মানেই অস্বাস্থ্যকর এমন একটি ধারণা ছিলো। মনে করা হতো তেল-চর্বি খেলে হূদরোগ ও ডায়াবেটিসের
মত জটিল রোগ হয়। কিন্তু
গবেষকরা দেখেছেন সব চর্বি ও তেলই মন্দ নয়। আছে চর্বির
ভালো-মন্দ, আছে ভালো-মন্দ
চর্বি। খাদ্যের চর্বিকে দু’ভাগে
দেখা যায়। স্যাচুরেটেড চর্বি ও আনস্যাচুরেটেড চর্বি। আনস্যাচুরেটেড চর্বি হলো শ্রেষ্ঠ। স্যাচুরেটেড চর্বি বেশি খেলে যেসব রোগ হয়, সেই চর্বির বদলে আনস্যাচুরেটেড চর্বি খেলে সেসব রোগ অনেক কমে যায়। আবার আনস্যাচুরেটেড চর্বিও দু’রকম। মনো-আনস্যাচুরেটেড ও পলি-আনস্যাচুরেটেড চর্বি। দু’ধরণের চর্বির হিতকরী প্রভাব রয়েছে রক্তের কোলেস্টেরল মানের উপর। আমাদের রক্তেও রয়েছে মন্দ কোলেস্টেরল এবং ভালো কোলেস্টেরল। রক্তের এলডিএল হলো মন্দ কোলেস্টেরল এবং রক্তে এর মান বেশি হলে ধমনীতে চর্বি জমা হওয়া, পরবর্তীতে করোনারি হূদরোগের মত বিপদ ঘটার সম্ভাবনা থাকে। আবার রক্তে
আছে ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএল। রক্তে এইচডিএল কোলেস্টেরল বেশি থাকলে
ধমনীতে ও টিসুতে জমা বাড়তি কোলেস্টেরল সরে আসে এবং
যকৃত দিয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে
যায়; কমে রক্তের মন্দ
কোলেস্টেরল। মন্দ ও ভালো দু’ধরণের কোলেস্টেরলের
অনুপাতও জানা জরুরী। এলডিএল:এইচডিএল অনুপাত যত কম হবে তত ভালো। যেমন এলডিএল মাত্রা ১০০ মিলিগ্রাম / ডিএল এবং এইচডিএল মাত্রা ৫০ মিলিগ্রাম/ডিএল হলে অনুপাত ২:১ এবং এই মাত্রাটি অবশ্য হূদস্বাস্থ্যকর। তাই এলডিএল কম হলে, এইচডিএল বেশি হলে এবং এদের অনুপাত কম হলে তা হবে স্বাস্থ্যকর ও হূদযন্ত্রের জন্য হিতকর।
মনো আনস্যাচুরেটেড চর্বি যেমন- জলপাইতেল, সানফ্লাওয়ার ও তিলের তেল ইত্যাদি যেমন কমায় রক্তের এলডিএল, তেমনি বাড়ায় হিতকর এইচডিএল। পলিআনস্যাচুরেটেড চর্বি যেমন কমায় এলডিএল ও মোট কোলেস্টেরল মাত্রা। তবে এইচডিএল তেমন বাড়ায় না, ক্ষেত্রবিশেষে কমায়।
পলি-আনস্যাচুরেটেড চর্বি হচ্ছে সোয়াবিন তেল, কর্নতেল, তৈলাক্ত মাছ, বাদাম ও বীজে। পলি আনস্যাচুরেটেড চর্বির মধ্যে
ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৩ এই
দু’ধরণের মেদ অম্লের অনুপাতটিও গুরুত্বপূর্ণ। দু’ধরণের চর্বির রাসায়নিক গঠনটি শরীরের উপর প্রভাব ফেলে ভিন্নভাবে। খাদ্যে দু’রকম চর্বি দরকার। এবং
অনুপাত ১:১ হলে ভালো।
ওমেগা-৩ মেদঅম্ল রয়েছে মাছের তেল, মাছ এবং সি ফুডে, যা কমায় হার্ট এ্যাটাকের ঝুকি, ওমেগা-৬ মেদঅম্ল রয়েছে সূর্যমুখীতেল, সফফ্লাওয়ার তেল, যা কমায় হূদরোগের ঝুঁকি। তবে এলার্জি ও প্রদাহের ঝুঁকিও বাড়ায়।
স্যাচুরেটেড ফ্যাটকে ভালো চর্বি
বলা যায়না। গোস্তের চর্বি ও দুধের চর্বি-ধমনীতে চর্বি জমা হওয়ার পেছনে এর কম চর্বি খাবারে বেশি খাওয়া সম্প্রকৃত। গৃহতাপে
এই চর্বি জমাট হয়ে থাকে। এর কম চর্বি বেশি খেলে রক্তে বাড়ে মোট কোলেস্টেরল ও মন্দ কোলেস্টেরল। তবে স্যাচুরেটেড চর্বি একেবারে বাদ দিলেও হবেনা। এটি অবশ্য ভিটামিন ও মিনারেলের ভালো উত্সও বটে। অনেকে বলেন, উদ্ভিজ স্যাচুরেটেড ফ্যাট যেমন পাম তেল হতে পারে কিছুটা হূদহিতকর। তাদের মেদঅম্ল গঠন, রাসায়নিক সংযুক্তি ও বিপাকের ভিন্নতা তাদেরকে দিতে পারে হিতকরী বৈশিষ্ট্য। পথ্যবিধি সম্বন্ধে যে নির্দেশ রয়েছে এতে স্যাচুরেটেড ফ্যাটকে দৈনিক ৭% শতাংশের নিচে না নামাতে বলা হয়েছে।
নিকৃষ্ট চর্বি হলো ট্রান্সফ্যাট বা হাইড্রোজিনেটেড ফ্যাট। তরল উদ্ভিজ তেলকে হাইড্রোজিনেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কঠিন চর্বিতে রূপান্তরিত করা হয় ট্রান্সফ্যাট। এরকম চর্বি রয়েছে সব রকম প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্টফুড, ফ্রেকফ্রাই থেকে ডোনাট, কেক, পেস্ট্রি, কুকিস ও বিস্কুটে। এই চর্বি পরিত্যাজ্য। এটি খেলে কেবল যে মোট কোলেস্টেরল ও মন্দ কোলেস্টেরল দু’টোই বাড়ে তাই নয়, কমে হূদহিতকর এইচডিএলও। তাই এটি অবশ্যই বর্জন করা উচিত।
খাদ্যে চর্বি ও হূদরোগ
প্রসঙ্গ এবার
কিছু প্রশ্নও আসে, স্বাভাবিকভাবেই। কতটুকু চর্বি খেলে তা স্বাস্থ্যকর হবে। চর্বিতে যে মেদঅম্লগুলো আছে, এদের মধ্যে যে ভারসাম্য রাখা প্রয়োজন কোনটি হবে হিতকর। স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলোর মধ্যে কোনটি স্বাস্থ্যকর বেশি? এরকম চর্বি খেলে কেমন হবে এর প্রভাব দেহের কোলেস্টেরলের মাত্রার উপর? প্রশ্নটি সহজ কিন্তু
উত্তর বেশ জটিল। তবে খাদ্যের প্রভাব দেখার একটি উপায়:
তেমন খাদ্য গ্রহণের পর রক্তের
মোট কোলেস্টেরল, এলডিএল ও এইচডিএল এর পরিবর্তন লক্ষ্য
করা। আবার এলডিএল/
এইচডিএল অনুপাতটিও নজর
করা গুরুত্বপূর্ণ হবে। খাদ্যে কি পরিমাণ চর্বি থাকা উচিত? বিশ্বে স্বীকৃত সংস্থা এনসিইপি
গাইডলাইন ও আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের মতে চর্বি থাকা উচিত দৈনিক মোট ক্যালোরির ৩০-৪০%, কমের দিকে হলেই ভালো তবে ২০% শতাংশের কম যেন না হয়।প্রতিটি মেদ অনুতে রয়েছে তিনটি মেদঅম্ল। মেদঅম্লগুলো
হলো- স্যাচুরেটেড, মনো-আনস্যাচুরেটেড ও পলি আনস্যাচুরেটেড। এদের অনুপাত হওয়া উচিত, ১:১:১ এস:এম:পি চর্বির এমন অনুপাত থাকলে এতে এলডিএল:এইচডিএল অনুপাত
থাকে সর্বোত্তম। স্যাচুরেটেড ফ্যাটকে একটু কম রাখারই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে যে চার ধরণের স্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে খাদ্যে এর মধ্যে পামিটিক এসিড, যে এসিডটি রয়েছে উদ্ভিজ তেল পামতেলে একে অনেকটা গ্রহণীয় মনে করেন অনেকে। লিপিড প্রোফাইল ও এলডিএল/এইচডিএল অনুপাতের উপর এক ক্ষতিকর প্রভাব তেমন লক্ষণীয় নয়। পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটদের মধ্যে এন-৬ ও এন-৩ পরিবারের চর্বির একটি সুষম ভারসাম্য রাখাও প্রয়োজন। তাই লাইনোলিক এসিড ও লাইনোনেলিক এসিডের একটি স্মার্ট ভারসাম্য (৯.১) রাখা হূদহিতকর, এমন ধারণা অনেকের।
তাই হূদস্বাস্থ্যকর খাদ্যের সন্ধানে প্রথম পদক্ষেপে আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের পরামর্শ হলো-
lস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড ও ট্রান্সফ্যাটি এসিড হওয়া উচিত মোট ক্যালোরির ১০% শতাংশের কম (হূদরোগ থাকলে ৭% এর কম)।
lপলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড হওয়া উচিত মোট ক্যালোরির ৮-১০%।
lমনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড মোট চর্বি গ্রহণের বাকিটা-মোট ক্যালোরির ১০-১৫%।
lমোট চর্বি গ্রহণ ক্যালোরির ৩০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
lকোলেস্টেরল গ্রহণ দৈনিক হওয়া উচিত ৩০০ মিলিগ্রামের কম।
lসোডিয়াম গ্রহণ ২৪০০ মিলিগ্রামের বেশি প্রতিদিন
হওয়া ঠিক নয়।
রক্তে কোলেস্টেরল বেশি হলে ও করোনারি হূদরোগ প্রতিরোধে আমেরিকান হার্ট সমিতির
পরামর্শ হলো-
আমাদের খাদ্যে অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণের সাথে সাথে চর্বিও থাকা চাই। চর্বি হলো শক্তির উত্স। দেহকোষ ও স্নায়ুতন্ত্রের সুষ্ট কাজ কর্মের জন্যও এদের প্রয়োজন।
কিছু কিছু ভিটামিন শরীরে ঢোকার জন্য চর্বির উপস্থিতি চাই। আমাদের সুস্থ ত্বক ও কেশ থাকার জন্যও খাবারে চর্বি চাই। প্রচন্ডশীতে শরীরকে তাপ সুরক্ষণও দেয় চর্বি। তবে খাদ্যে চর্বি থাকবে সীমিত। মোট ক্যালোরির ৩০-৩৫
শতাংশের বেশি নয়। ২০% শতাংশের নিচে থাকা ঠিক নয়। বেশিরভাগ চর্বি থাকবে আনস্যাচুরেটেড। রান্নার
সময় জমাট চর্বির বদলে তরল
তেল ব্যবহার স্বাস্থ্য সম্মত। ঘি, ডালডার পরিবর্তে ভোজ্যতেল। ননীতোলা দুধ ও দুধজাত খাবার, কচি মোরগের মাংস (বুকের মাংস), প্রচুর মাছ। সামুদ্রিক তৈলাক্ত
মাছ, শাক সবজি ইত্যাদি। প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্টফুড
বর্জন করাই শ্রেয়। কেক, পেস্ট্রি, বিস্কিট, ডোনাট, ফ্রেঞ্ছফ্রাই, ফাস্টফুড এসবে আছে যে
ভয়ংকর চর্বি, ট্রান্সফ্যাটকে
বর্জন করা স্বাস্থ্যকর বটেই। ট্রান্সফ্যাটের বদলে তুলনামূলক
বেশি স্বাস্থ্যকর স্যাচুরেটেড
ফ্যাট, যা হতে পারে
প্রকৃতিজাত এর অন্তেভুক্তি এবং
খাদ্যে চর্বির মধ্যে তিন ধরণের
মেদ অম্লের সমান অনুপাত ১:১:১ প্রচলন করে দেখা যেতে পারে। বর্তমান অনেক ভোজ্য তেলে
অনেক ব্যবসায়ী নিজেরাই
যে মিশ্রণ শুরু করেছেন, নানা
রকম তেলের যে অনুপাত এতে রয়েছে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব
বিবেচনার দাবী রাখে।
পুষ্টি উপকরণ ধাপ ১ খাদ্য/ ধাপ-২ খাদ্য/
মোট ক্যালোরি মোট ক্যালোরি
মোট কোলেস্টেরল ৩০% বা কম ৩০% বা কম
স্যাচুরেটেড ৭-১০% <৭%
পলিআলস্যাচুরেটেড ১০% পর্যন্ত ১০% পর্যন্ত
মনোআনস্যাচুরেটেড ১৫% পর্যন্ত ১৫% পর্যন্ত
শর্করা ৫৫% বা বেশি ৫৫% বা বেশি
প্রোটিন ১৫% ১৫%
কোলেস্টেরল <২০০ মিলিগ্রাম/দিনে <২০০ মিলিগ্রাম/দিনে
মোট ক্যালোরি
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক
ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস
বারডেম, ঢাকা
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন