বাংলাদেশ উন্নয়নের নয়া রূপকল্প : শেখ হাসিনা
২৬ মে ২০১৬, ১১:৩২
জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক সূচকে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে উত্থান ঘটেছে বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর, এমনকি আশির দশকেও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে টিকে থাকতে পারবে কি না তা নিয়ে অনেক পর্যবেক্ষক সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আমরা তাদের সন্দেহকে ভুল প্রমাণ করেছি। এটি সম্ভব হয়েছে দেশের মানুষের ঐকান্তিকতা ও আমাদের সাহসী পদক্ষেপ—এ দুইয়ের সমন্বয়ে। ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে, যা আমাদের পৌঁছে দিয়েছে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সরণিতে। আমাদের দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘ভিশন ২০২১’-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা বর্তমানে বাস্তব রূপ লাভ করছে।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ ডলার। চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে এক হাজার ৪৬৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে। সাত বছর ধরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬.৩ শতাংশ। চলতি বছর এটি বেড়ে ৭.৫ শতাংশ হবে বলে আমরা আশা করছি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে; যা ২০০৫-২০০৬ সালে ছিল তিন বিলিয়ন ডলার। দারিদ্র্যসীমা ১৯৯০ সালে ছিল ৫৬ শতাংশ; ২০১৫ সালে ২২.৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ কাজে লাগানোর কথা ভেবে প্রণীত। দেশে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও রয়েছে। আমাদের বিনিয়োগব্যবস্থা এ অঞ্চলের সবচেয়ে উদার ব্যবস্থার একটি। আমাদের বিনিয়োগবান্ধব নীতি বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ফলে দেশে গতিশীল উন্নয়ন হচ্ছে, পাশাপাশি বেসরকারি খাত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ঝুঁকি একেবারেই কম। আমরা শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেই, যেখানে অবাধ প্রস্থান নীতি, লভ্যাংশ সহজে দেশে পাঠানো, বিদেশি বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীল জ্বালানির মূল্যের নিশ্চয়তা রয়েছে।
বাংলাদেশ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতার দেশ। আমাদের সরকার জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এবং সফলভাবে চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদের উত্থান মোকাবিলা করছে।
গণমুখী উন্নয়ন মডেলের মাধ্যমে আমরা জনগণকে বোঝা নয়, সম্পদে পরিণত করেছি। আজ আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধিতে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ১০ কোটি পাঁচ লাখ মানুষ (মোট জনসংখ্যার ৬৫.৬২ শতাংশ) সরাসরি অবদান রাখছে। আমি দেখছি, আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের তরুণ সমাজ।
গত সাত বছরে আমরা অবকাঠামো, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ও বন্দরের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা তিন গুণ হয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছি। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পের মধ্যে স্বপ্নের পদ্মা সেতু (৩.৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়) আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের ধারণক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে এবং পায়রা ও কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর শিগগির নির্মাণ করা হবে। আমরা দেশজুড়ে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছি, যেখানে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে ২০৩০ সালের মধ্যে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। ৩৩টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন চলছে এবং ২০১৭ সালের মধ্যে অন্তত ১০টির কাজ শেষ হবে।
তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। তবে এ অঞ্চলে বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমরা রপ্তানি পণ্যের তালিকায় বৈচিত্র্য আনতে চাই। এ জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশে এখন জাহাজ থেকে চিপস, সব কিছু উৎপাদন হয়। আমরা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, কারিগরি দক্ষতা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও বিনিয়োগের জন্য সমন্বিত নীতি প্রণয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
নারী উন্নয়ন নিয়ে দ্য গ্রুপ অব সেভেন (জি-৭) সামিটে আলোচনা করা হবে বলে আমি খুশি হয়েছি। আমরা দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মূল ধারায় নারীকে নিয়ে আসার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে আমাদের উচ্চাশা আছে। এ নীতির লক্ষ্য হচ্ছে, নারীদের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ তৈরি করা। আমরা নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক আত্মনির্ভরশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছি এবং এই কৌশলের ফল পেয়েছি। ২০১৪ সালের বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৬৮তম স্থানে রয়েছে। আমরা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি এবং স্নাতক পর্যন্ত অবৈতনিক করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৭২ লাখ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে খাদ্যের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ফলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমেছে এবং প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলে-মেয়ের লৈঙ্গিক সমতা অর্জন হয়েছে।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমরা সপ্তম স্থান অর্জন করেছি। বর্তমানে জাতীয় সংসদে ৭০ জন নারী রয়েছেন এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সাড়ে ১২ হাজারেরও বেশি নারী নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা এবং স্পিকার—সবাই নারী। সাহসী পদক্ষেপ এবং সামাজিক সচেতনতা—এ দুইয়ের সমন্বয়ে রাজনীতি ও নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও শুচিতা ব্যবস্থা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। জন্মহার ৩.৪ শতাংশ থেকে কমে ২.২ শতাংশে এসেছে। নবজাতকের মৃত্যুর হার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রতি হাজারে ৯৭ জন মারা যেত, ২০১৫ সালে এ হার ছিল হাজারে ৩১ জন। একই সময়ে শিশুমৃত্যু হার দুই-তৃতীয়াংশ ও মাতৃমৃত্যু হার তিন-চতুর্থাংশ কমেছে। এখন জন্মকালীন শিশুমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সত্যিই সম্ভাবনাময় এক দেশ। আমাদের উন্নয়ন সে কথাই বলছে। হতাশাবাদীরা যে ভুল, তা আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের ঐকান্তিকতা, আমাদের সংকল্প, আমাদের উদ্ভাবনী ও অদম্য শক্তির মাধ্যমে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। আমরা দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কিভাবে জাপান স্বল্প সময়ের মধ্যে পুনরুত্থিত হয়েছে, অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমাদের অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার আকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিজ্ঞা অআমলযোগ্য নয়।
আমি জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করি। আমরা একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব ২০২১ সালের মধ্যে, যখন আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি পালন করব। আশা করি ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশগুলোর কাতারে পৌঁছতে পারব। আমাদের উন্নয়ন যাত্রায়, আমরা এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে, বিশ্বের অন্যান্য অংশের সঙ্গে মিলে কাজ করতে চাই, যাতে আমাদের জনগণের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটে, যাতে একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধতর বিশ্ব গড়ে তোলা যায়।
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন