কাঁদলেন, কাঁদালেন সবাইকে ‘মানুষের ভালোবাসাই আমার প্রাণশক্তি’ : শেখ হাসিনা
১১ জুন ২০১৬, ০৩:৪৬
হাজার হাজার মানুষ ওই সময় দু’হাত উঁচিয়ে বঙ্গবন্দুকন্যার নেতৃত্বের প্রতি শতভাগ একাগ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এ সময় শেখ হাসিনার দু’চোখ বেয়ে অঝোরে পানি নামে। কান্না লুকাতে তিনি একপর্যায়ে কিছু সময়ের জন্য বিস্তীর্ণ খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন।কিন্তু কান্না লুকাতে পারেননি তিনি। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকেন। চোখের পানি মোছেন। পানিতে ঝাপসা হয়ে থাকা চোখের চশমা খুলে হাতে নেন।
১২ জুন ২০০৮,সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অঝোরে কাঁদলেন। হাজারো ভক্ত-অনুরাগীকে কাঁদালেন। আবার মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে আন্দোলনের অঙ্গীকার করলেন। ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দীপনা জোগালেন। দু’হাত উঁচিয়ে তার আশু রোগমুক্তির জন্য দোয়া করার আহ্বান জানালেন।
সমবেত হাজারো নেতা-কর্মী, সমর্থকদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা কোনো কথা বলেননি, বলতে পারেননি। আবেগের বশর্বতী হয়ে তিনি কেবলই কেঁদেছেন। বার বার চোখের পানি মুছেছেন। শেখ হাসিনার চোখে পানি দেখে কেঁদেছেন সবাই। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদেছেন কর্মীদের অনেকে। শেখ হাসিনা কথা না বলেও ইশারায় তাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন।
গতকাল ভোরের আলো ফিকে হয়ে আসার আগ থেকেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সুধা সদনমুখী হতে থাকেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়তে থাকে। শেখ হাসিনা আসার আগেই সেখানে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যখন র্যাবের হালকা কালো রংয়ের গাড়িতে করে এসে পৌঁছান, তখন সুধা সদন জনসমদু্রে রূপ নেয়। রীতিমতো বাঁধভাঙা জোয়ার নামে সেখানে। মানুষের ঢল নামে।
ভালোবাসার বিড়ম্বনায় পড়ে গাড়ি থেকে নেমে সুধা সদনের ভেতরে যেতে শেখ হাসিনার সময় লেগেছে ১৫ মিনিটেরও বেশি। গাড়ির চারদিকে কর্মীদের উপচেপড়া ভিড়। ভিড়ের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে নিরাপত্তা কর্মীদের। এ কারণে শেখ হাসিনাকে প্রথা ভেঙে গাড়ির ডান দিকের দরজা দিয়ে বেরুতে হয়েছে। ওই সময় তার গাড়ি ফুলে ফুলে প্রায় ঢেকে যায়। ফুলেল ভালোবাসায় সিক্ত হন শেখ হাসিনা।
সুধা সদনে প্রবেশ করেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সোজা গাড়ি রাখার বারান্দার ব্যালকনিতে গিয়ে অপেক্ষমাণ সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। উৎফুল্ক্ন হয়ে হাসিমুখে হাত নেড়ে কর্মীদের অভিনন্দিত করেন। ঘিয়ে রংয়ের টাঙ্গাইল শাড়ি পরিহিত শেখ হাসিনা যেন তখন বাঙালি নারীর মূর্তমান প্রতিকৃতি। হাজার হাজার মানুষ ওই সময় দু’হাত উঁচিয়ে বঙ্গবন্দুকন্যার নেতৃত্বের প্রতি শতভাগ একাগ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান।
এ সময় শেখ হাসিনার দু’চোখ বেয়ে অঝোরে পানি নামে। কান্না লুকাতে তিনি একপর্যায়ে কিছু সময়ের জন্য বিস্তীর্ণ খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন।কিন্তু কান্না লুকাতে পারেননি তিনি। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকেন। চোখের পানি মোছেন। পানিতে ঝাপসা হয়ে থাকা চোখের চশমা খুলে হাতে নেন।
ওই সময় চারদিকে পিনপতন নীরবতা নামে। সমবেত সবাই তখন তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকেন তাদের প্রিয় নেত্রীর দিকে। আবেগের বশর্বতী হয়ে অনেকে কাঁপছিলেন। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর শেখ হাসিনা মুষ্ঠিবদ্ধ ডান হাত উঁচিয়ে আন্দোলনের তাগিদ দেন। সমবেত সবাই তখন তার সঙ্গে একাত্ত হন। তারাও দু’হাত উঁচিয়ে শেখ হাসিনাকে অভয় দেন, সাহস জোগান। স্ট্নোগান তোলেন : ‘রাজপথের সংগ্রাম, চলছে চলবে/লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই/দিয়েছি তো রক্ত, আরো দেব রক্ত/রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়/হাসিনা তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে/শেখ হাসিনা এসেছে, বীর বাঙালি জেগেছে/ আজকের এই দিনে, মুজিব তোমায় মনে পড়ে’।
এ সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আবারো আবেগপ্রবণ হন। একপর্যায়ে ডুকরে কাঁদেন তিনি। এ সময় র্যাব সদস্যরা চোখ মোছার জন্য টিস্যু পেপার এগিয়ে দিলে তিনি তা সরিয়ে আঁচল দিয়ে পানি মোছেন। দু’হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিমায় তার জন্য দোয়া করার আহ্বান জানান। ইশারায় বুঝিয়ে দেন, ‘আমি সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসব তোমাদের মাঝে, বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবের দেশে।’ এ সময় দুঃখ জাগানিয়া অসম্ভব এক কষ্ঠবোধ তাকে আঁকড়ে ধরে।
শেখ হাসিনা এরপর দোতলা থেকে নেমে নিচতলার ড্রয়িংরুমে এসে অপেক্ষমাণ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদ নেতাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। অনেকেই পা ছুঁয়ে তাকে সালাম করেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর অনুপস্থিতিতে শক্ত হাতে দলের দায়িত্ব পরিচালনা করে আসা র্বষীয়ান জিল্লুর রহমান ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে দলীয় প্রধানকে স্বাগত জানান। সেখানেও আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও বেগম মতিয়া চৌধুরীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। ওই সময় নেতাদের সবাই কেঁদেছেন।
ড্রয়িংরুমে রাখা সোফায় বসে শেখ হাসিনা নেতাদের কুশলাদি জানেন। এ সময় তার ডান পাশের সোফায় জিল্লুর রহমান ও বাম পাশে বসেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তিনি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলেছেন। কাছাকাছি অবস্থানে থেকে দুই নেতার কথা শুনেছেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
আট মিনিটের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর শেখ হাসিনা দোতলায় গিয়ে তার অসুস্থ স্বামী বিশিষ্ঠ পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে দু’জনই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এ সময় শেখ হাসিনা দু’রাকাত শোকরানা নামাজও আদায় করেছেন। এরপর সেগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, হাসিনা দৌলা ও শাহিদা তারেক দীপ্তিসহ কয়েকজন আন্তীয়কে দেখতে পেয়ে শেখ হাসিনা তাদেরও জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদেন। তিনি তাদের আদর দেন, সান্ত্বনা জানান। তারা বিশ্রামে যাওয়ার অনুরোধ করলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে থাকলে তিনি কখনোই ক্লান্ত হন না। মানুষই তার শক্তি। মানুষের অফুরান ভালোবাসাই তার প্রাণশক্তি।’ বাইরে তখনো মানুষের ঢল। এ দেখে শেখ হাসিনা বললেন, ‘এত মানুষ, এত ভালোবাসা, আমি আবার ব্যালকনিতে যাব।’
শেখ হাসিনা এবার তিনতলার ব্যালকনিতে এসে জনতার শুভেচ্ছার জবাব দেন। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা সোয়া তিনটা। শেখ হাসিনাকে দেখতে পেয়ে মানুষজন আবারো স্লোগান তোলেন। শেখ হাসিনা নিজেও মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে মুক্তি জাগানিয়া স্লোগান তোলেন ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্দু।’ এরপর থেকে তিনি ১০ মিনিট পরপর ব্যালকনিতে এসে অপেক্ষমাণ জনতাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে সুধা সদনের সামনে জনতার ভিড়ও বেড়েছে। ঢাকার আশপাশ থেকেও নেতা-কর্মীরা ছুটে এসেছেন। তখন সুধা সদনের দেয়ালের একপাশে বঙ্গবন্দুর হাস্যোজ্জ্বল ছবি শোভা পাচ্ছেল।