ভারত ও অামেরিকার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি
৩১ আগস্ট ২০১৬, ১১:০৩
ভারত ও আমেরিকা একে অন্যের বহরকে অবকাঠামোগত সুবিধা দেবার লক্ষ্যে নজিরবিহীন এক চুক্তি সই করেছে।
ভারত ও আমেরিকা যাতে পরস্পরের সামরিক ঘাঁটিগুলোতে রসদ ভরার ও মেরামতির জন্য অ্যাক্সেস পায়, তা নিশ্চিত করতে দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এই চুক্তির ফলে দুই দেশের সামরিক বাহিনী একে অন্যের নৌ, বিমান বা সেনা-শিবিরগুলোতে গিয়ে নতুন শক্তিতে বলীয়ান হতে পারবে, সামরিক পরিভাষায় যাকে বলে ‘রিপ্লেনিশমেন্ট’।
স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক পরাক্রমের মোকাবিলা করার জন্যই ভারত ও আমেরিকা এই নজিরবিহীন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার পথ বেছে নিয়েছে।
ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় সোমবার বিকেলে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশটন কার্টার ও তাঁর ভারতীয় কাউন্টারপার্ট মনোহর পারিক্কর পেন্টাগনে যে সমঝোতায় সই করেন, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনও চুক্তি আগে কখনও হয়নি।
এই চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর মি: কার্টার জানান, এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপের ফলে দুদেশের যৌথ সামরিক অভিযান চালানো এখন অনেক সহজ হয়ে যাবে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কথায়, “গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এ এক অবিস্মরণীয় পালাবদল। এর ফলে আমাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এখন একটা অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবে, এবং আমেরিকার দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে আমরা শুধু আমাদের দীর্ঘকালের ও ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশগুলোর সঙ্গেই এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।’’
মি: কার্টার গত এক বছরে যে বিদেশি মন্ত্রীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন বলে নিজেই স্বীকার করেছেন – সেই ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্কর অবশ্য এটা বোঝাতেও সচেষ্ট ছিলেন যে এই চুক্তির ফলে আমেরিকা ভারতের মাটিতে সামরিক ঘাঁটি চালু করবে ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।
এই চুক্তির ফলে দুই দেশের সামরিক বাহিনী একে অন্যের নৌ, বিমান বা সেনা-শিবিরগুলোতে গিয়ে নতুন শক্তিতে বলীয়ান হতে পারবে।
মি: পারিক্করের কথায়, “এর মাধ্যমে একে অন্যের মাটিতে কোনও মিলিটারি বেস তৈরি করবে না। তবে আমরা একে অন্যের বহরকে অবকাঠামোগত সুবিধা দেব – যেমন জ্বালানি বা অন্য রসদের সরবরাহ করা হবে যাতে যৌথ অভিযানে সুবিধে হয়, মানবিক সহায়তা বা ত্রাণ অভিযানের কাজেও পরস্পরকে সাহায্য করব।’’
তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মি: পারিক্কর বিষয়টার গুরুত্বকে একটু খাটো করে দেখাতে চাইলেও এই চুক্তি যে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সামরিক সম্পর্কে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে তা নিয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞরা প্রায় সবাই একমত।
ভারতের প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমরা এতদিন নন-অ্যালাইনড বা নিরপেক্ষ ছিলাম। কিন্তু এখন আমরা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে আর নিরপেক্ষ থাকতে পারছি না, বরং আমেরিকার সাথে অ্যালাইনড হয়েছি – এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে সেটাই মেনে নিলাম।’’
“তবে এখন আমাদের ডানদিক বাঁদিকও দেখতে হবে, রাশিয়ার মতো আমাদের যে সব পুরনো বন্ধু দেশ ছিল তারা নিশ্চয় তাদের প্রতিক্রিয়া জানাবে। সে সব দেখেশুনেই ভারতকে এগোতে হবে, যদিও এখনই সে ব্যাপারে কথা বলার সময় আসেনি।’’
আসলে এই চুক্তির মধ্যে যেমন রাশিয়ার মতো পুরনো ও আস্থাভাজন সামরিক মিত্রর কাছ থেকে ভারতের সরে আসার ইঙ্গিত আছে, তেমনি আছে চীনের মতো সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীর মোকাবিলার প্রস্তুতিও। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন জেনারেল রায়চৌধুরী।
তিনি আরও বলছেন, “এর আসল লক্ষ্য যে চীন তা তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। চীন বহুদিন ধরেই পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। পাকিস্তান আমাদের তাৎক্ষণিক শত্রু হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমাদের টক্কর দিতে হবে চীনের সঙ্গেই।’’
এই বাস্তবতাটা অনুধাবন করেই ভারত আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
এই চুক্তির ফলে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারকে দেশের ভেতরে সামরিক স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করার অভিযোগে সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে বলেও অনেকে ধারণা করছেন।
কিন্তু বিশ্বের স্ট্র্যাটেজিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে দিল্লি যে এখন তাদের বহু বছরের সামরিক কূটনীতিতেও পরিবর্তন আনতে তৈরি, এই চুক্তি তারই প্রমাণ।