আওয়ামী লীগ নেতা তজমুল আলী চেয়ারম্যানের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২১:৩৩
ষাট থেকে নব্বই দশকের রাজনীতিতে ফেঞ্চুগঞ্জের মাটিতে বেড়ে ওঠা অন্যতম সাংগঠনিক কৌশলী, আদর্শের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন, সর্বজন স্বীকৃত আওয়ামী নেতা এবং ২ নং মাইজগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সফল চেয়ারম্যান শেখ তজমুল আলীর ২১ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি ঢাকার আল রাজী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। স্বল্প সময়ে গর্জে ওঠা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইউপি চেয়ারম্যানদের একজন শেখ তজমুল আলীর অকাল মৃত্যু ফেঞ্চুগঞ্জ জুড়ে নিয়ে আসে সেদিন শোকের ছায়া।
তজমুল আলী ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত সৎ, পরিশ্রমী ও ন্যায়-নীতির মূর্ত প্রতীক ছিলেন। কিশোর তজমুল তার যোগ্যতার জোরে ১৯৬৮ সালেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে সরাসরি ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হোন। তারুণ্যে ভরপুর তজমুল আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের পথপ্রদর্শক।
তৃণমূলের রাজনীতি থেকে বেড়ে ওঠা এই গণমানুষের নেতা ১৯৭০ সালে মাইজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজ হাতে লিখিত মানপত্র পাঠ করে শুনান। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও স্বাধীন বাংলা ছাত্রলীগ ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন রতনের ভাষ্যমতে তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তজমুল আলীকে জনসম্মুখে ডেকে নিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলেন- তজমুল আলী একদিন জাতীয় নেতা হবেন। বঙ্গনেতা যে রত্ন চিনতে ভুল করেননি, সেই তজমুল আলী মুজিব বাহিনীর অন্যতম একজন সদস্য হিসেবে স্বাধীন বাংলা গঠন এবং তার নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭২ সালে তজমুল আলী ফেঞ্চুগঞ্জের ২নং মাইজগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হোন, যেখানে তৎকালীন সময়ের চেয়ারম্যান অপেক্ষা তিনি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী ভোট পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অর্জিত তার সেই জনপ্রিয়তা সকলকে অবাক করে দেয়।১৯৭২ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী ফেঞ্চুগঞ্জ নেমেই তজমুল আলীর তলব করেন। জেনারেল ওসমানী বলেন, “আমি তজমুল কে দেখছিনা, খবর দাও” বলে ডেকে নিয়ে সাক্ষাৎ করেন।১৯৭৪ সালে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হোন। সেসময় তিনি অত্যন্ত সততা এবং নিষ্ঠার সাথে প্রতিটি দায়িত্ব পালন করেন। তার ন্যায়পরায়ণতার স্বীকৃতিস্বরূপ তজমুল আলী প্রারম্ভিক অবস্থা থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট তজমুল আলী তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত পান। তার পরদিন সকালে তিনি সকল বাধা উপেক্ষা করে প্রতিবাদ করেন এবং জনসম্মুখে মিলাদ মাহফিল পড়ান। সেই সময়ের ছাত্রনেতা মুহিব উদ্দিন বাদল, সামছুদ্দীন কুমী সহ ১০-১১ জন বঙ্গবন্ধু সৈনিক তখন সাহসী হয়ে ওঠেছিলেন এবং রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন। ১৪৪ এর শান্ত আইন ভাঙতে তজমুল আলীর সবচেয়ে কাছের মানুষ ডাঃ মিনহাজ উদ্দিন, আব্দুল লতিফ, এড. এমলেন্দু, এ আর সেলিম, ফিজিক্যল স্যার, নাসির উদ্দিন রতন সহ অনেকেই মৃত্যুমুখে ডাকবাংলায় জয় বাংলা বলে মোস্তাক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। উত্তপ্ত ফেঞ্চুগঞ্জের সেই প্রতিবাদের ভাষা অনুপ্রাণিত করেছিল বঙ্গবন্ধুপ্রেমী সকল কৃষক-শ্রমিক মানুষদেরও।
১৯৭৭ সালে তিনি পুনরায় ইউপি মেম্বার নির্বাচিত হোন এবং এলাকার উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষিত অভিনন্দন পত্র গ্রহণ করেন। সাধারণ জনতার আশা আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলনের ধারক এবং বাহক ছিলেন তজমুল আলী। ১৩ জুলাই ১৯৭৯ সালে তিনি আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দলপতি পত্র (সম্মাননা স্মারক) গ্রহণ করেন।
১৯৭৯ সালে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তার বাল্য বন্ধু আব্দুল লতিফকে তিনি এতটাই সম্মান করতেন ও বড় মানতেন যে, তিনি তখনই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব আব্দুল লতিফের উপর অর্পণ করে প্রথম সাংগঠনিক পদ গ্রহণ করেন। এমন চিত্র , যা বর্তমান রাজনৈতিক চিত্রে বিরল।১৯৮০ সালে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা শ্রমিকলীগের সভাপতি নির্বাচিত হোন এবং সারকারখানা শ্রমিকদের দাবি আদায়ে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন।সর্বদলের কাছে সম্মানের পাত্র এই জননেতা ১৯৮৪ সালে সিলেট সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তৎকালীন সময়ে তজমুল আলী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সংস্পর্শে থেকে সিলেট বিভাগব্যাপী তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে জোর ভূমিকা পালন করেন।১৯৮৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক তৃণমূল আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও দলকে সুন্দর একটি গাঠনিক রূপ দেয়ার স্বার্থে ২নং মাইজগাঁও আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সেসময় তিনি সেচ্চায় সাংগঠনিক পদ ছেড়ে দিয়ে মাইজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।১৯৯১ পরবর্তীতে তজমুল আলী ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা গণদাবী পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক এবং সারকারখানা রক্ষা আন্দোলনে রাজপথ দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। যেখানে আব্দুল লতিফ, ডাঃ মিনহাজ এবং লুৎফুর রহমান তার ঘনিষ্ট পরিকল্পনা সঙ্গী ছিলেন।
শ্রমিকসমাজের কাছের নেতা তজমুল আলী সর্বপ্রথম ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় স্থানীয় শ্রমিকদের চাকুরীর দাবী জানান। সকল লোভ-লালসার উর্দ্ধে গিয়ে স্থানীয় শ্রমিকদের কল্যাণে তার সৎ নীতিতে অটল থাকা এবং তার আত্মত্যাগ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিলো। সেদিন তজমুল আলীর সততা, যুক্তি এবং সাহসিকতাপূর্ণ নেতৃত্ব স্থানীয় শ্রমিকদের মুগ্ধ করেছিল এবং তিনি সফল হয়েছিলেন।
তজমুল আলী অসংখ্য সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা/ সভাপতি/ সম্পাদক ছিলেন। ক্রীড়াঙ্গনের মান উন্নয়নে তজমুল আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তার ঘনিষ্টজন আরফান আলী, ডাঃ মিনহাজ উদ্দীন, আব্দুল লতিফ, ডাঃ আর কে দাস, নাসির উদ্দিন রতন সহ অনেকেই বিভিন্ন সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জ আওয়ামীলীগের হাল ধরেন।
তজমুল আলী এসএসসি পাশ করেন কাসিম আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং তিনি একাধিকবার ফেঞ্চুগঞ্জ থানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ সভাপতি নির্বাচিত হোন। বিভিন্ন সালিশে দল মত নির্বিশেষে তজমুল আলীর দৃঢ় সিদ্ধান্ত স্থানীয় ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে আলোকিত করেছিল। তাছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নারী-শিশু-শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে তজমুল আলী তার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেন।
অতি অল্প সময়ে দেশের শ্রেষ্ঠ ২৪ জন চেয়ারম্যানদের অন্যতম একজন নির্বাচিত হওয়া সহ ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা বর্জ্য পদার্থ সম্পৃক্ত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনে তজমুল আলী চেয়ারম্যান অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে মাটি ও মানুষের গান গেয়ে যাওয়া তজমুল আলী সেই লক্ষ্যে কাজ করতেন, যে পরিবর্তন সমাজের উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
২৯ নভেম্বর ১৯৯৭, দৈনিক মানচিত্রের ভাষ্যমতে তজমুল আলী এমন এক নেতা, যিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মানুষের গান গেয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ মানুষের জন্য এবং সবার ওপরের মানুষ সত্য। তজমুল আলী চেয়ারম্যান এমন পরিবর্তন চেয়েছিলেন, যা মানুষকে তার ব্যক্তিত্ব, তার সত্ত্বা, তার মূল্যবোধ, তার অধিকার প্রভৃতি সম্পর্কে সচেতন রাখবে। যে পরিবর্তন মানুষের ক্ষেত্রে তার সামগ্রিক চিন্তা চেতনায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে। যে পরিবর্তন সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের চিন্তা চেতনাকে কম্পিত করবে।
এলাকার উন্নয়নে তজমুল আলী চেয়ারম্যান প্রত্যেক এলাকা ঘুরে এলাকার মুরব্বীয়ান এবং যুবকদের নিয়ে প্রথমে এলাকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতেন এবং পর্যায়ক্রমে গুরুত্ব অনুসারে সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।
শতশত নেতা গড়ার কারিগর শেখ তজমুল আলী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগার হলেও প্রতিপক্ষ নেতৃত্বের মুখে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে প্রশংসিত হতেন। তজমুল আলীর আন্তরিকতা প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করে না, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ একতা এবং সফলতায় বিশ্বাস করে। মৃত্যুকালে স্ত্রী সহ চার শিশু সন্তান রেখে যাওয়া তজমুল আলীকে ফেঞ্চুগঞ্জের মাটি ও মানুষের একতা, কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিকতা ধরে রেখেছে ইতিহাসের পাতায়। বাক্যে নয়, কর্মে বিশ্বাসী এই মহান নেতার ২১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তাকে গভীর শ্রদ্ধা ও সশ্রদ্ধ সম্মানের সাথে স্মরণ করছি
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন