বেহাত রিজার্ভের পুরো অর্থ ফিরে পাওয়া নিয়ে সংশয়
১২ মার্চ ২০১৬, ১০:০৯
নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি অ্যাকাউন্ট থেকে এখনো বেহাত থাকা আট কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৬৩৫ কোটি টাকা আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) জানিয়েছে, বেহাত থাকা ৬৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩৬১ কোটিই ফিলিপাইনের জুয়ার আসর ক্যাসিনোতে খরচ হয়ে গেছে। বাকি টাকা ফিলিপাইন থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এএমএলসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশটির সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এটা খুবই অস্পষ্ট যে চুরি হওয়া অর্থের মধ্য থেকে এএমএলসি কতটা জব্দ করতে পারবে বা কী পরিমাণ অর্থ আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে ফেরত দিতে পারব, তা বলা সম্ভব নয়।’
এদিকে হ্যাক করে রিজার্ভ চুরির ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা বা দেশের কোনো নাগরিক জড়িত রয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখছে র্যাব, ডিবি ও সিআইডি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কমিটি তিনটি আইডি শনাক্ত করেছে। এ আইডিগুলো থেকেই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কের কাছে অর্থ স্থানান্তরের নির্দেশনাগুলো পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক এ এফ এম আসাদুজ্জামান গতকাল শুক্রবার জানিয়েছেন, সাইবার আক্রমণে মোট ৩৫টি ভুয়া পরিশোধ নির্দেশে ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার বা সাত হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ নেওয়ার চেষ্টা করেছে হ্যাকাররা। এর মধ্যে ৩০টি নির্দেশের ৮৫ কোটি ডলার বেহাত হওয়ার শুরুতেই প্রতিহত করা গেছে। বাকি পাঁচটি নির্দেশে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার বেহাত হয়েছে। এর মধ্যে দুই কোটি ডলার ফেরত আনা গেছে। বাকি আট কোটি ১০ লাখ ডলার ফেরত আনার সর্বাত্মক প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।
ফিলিপাইনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ‘ফিলিপাইন অ্যামিউজমেন্ট গ্যামিং করপোরেশন (পাগোর)’ প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে, সোলারি রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনোর আসরে দুই কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং ইস্টার হাওয়াই ক্যাসিনো অ্যান্ড রিসোর্টে দুই কোটি ডলার খরচ হয়েছে। অর্থাৎ দুই জুয়ার আসরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকারদের চুরি করা মোট আট কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ৫৬ শতাংশ বা চার কোটি ৬০ লাখ ডলার খরচ হয়েছে। এসব অর্থ নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ফিলিপাইনে ঢুকেছে গত ৫ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে।
ফিলিপাইনের তদন্ত কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, জুয়া খেলে যারা জিতেছে তারা সেই অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে নিজ দেশে (সম্ভবত হংকং) স্থানান্তর করেছে। হ্যাকারদের নেওয়া অর্থ দিয়ে খেলে বেশ কিছু খেলোয়াড় আবার জুয়ার আসরে হেরেছেও।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি করে ফিলিপাইনের রাইজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) মাক্তাই সিটির জুপিটার স্টেট শাখার মাধ্যমে হ্যাকাররা জুয়ার আসরে ব্যবহার করেছে। ওই শাখার ম্যানেজার মাইয়া স্যান্তোষ ডিগুইতুর ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব যাচাই-বাছাই করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন আরসিবিসির প্রেসিডেন্ট লরিঞ্জো তান। মাইয়া স্যান্তোষ নামে ওই নারী এর আগে দেশটির ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন, ২০১৩ সালে আরসিবিসি ব্যাংকে যোগ দেন। ব্যাংকিং খাতে তাঁকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাঁকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, কার নির্দেশে তিনি এই প্রশ্নবিদ্ধ অর্থ স্থানান্তর করেছেন, তা জানতে।
মাইয়া স্যান্তোষ ফিলিপাইন থেকে জাপানে পালাচ্ছিলেন। জাপানগামী একটি বিমান থেকে তাঁকে নামিয়ে দিয়েছে দেশটির বহির্গমন কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকেলে ম্যানিলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহির্গমন কর্তৃপক্ষ তাকে দেশ ছাড়তে দেয়নি। তার শাখায় খোলা পাঁচটি অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আট কোটি ১০ লাখ ডলার স্থানান্তর হয়েছে। ওই অ্যাকাউন্টগুলো খোলার ক্ষেত্রে গ্রাহকের পরিচয় বা তথ্য জেনে সংরক্ষণে রাখার কথা থাকলেও তিনি তা করেননি।
আরসিবিসির মালিকানায় রয়েছে তাইওয়ানের বৃহৎ জীবনবীমা কম্পানি ক্যাথে লাইফ ও বিশ্বব্যাংকের অঙ্গ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। ফিলিপাইনের শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, এই শাখা ম্যানেজার ওই ব্যবসায়ীর স্বাক্ষর জাল করে তাঁর নামে গোপনে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। বাংলাদেশের অর্থপাচারের ঘটনায় এখন ওই ব্যবসায়ীর নামও জড়িয়ে পড়েছে।
রিজার্ভের অর্থ কিভাবে হ্যাকড হলো তা অনুসন্ধানের জন্য সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক তদন্ত সংস্থা ‘ফায়ারআই ইনকরপোরেশন’ এর সহায়তা নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে পরামর্শক ‘ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্স’ এর মাধ্যমে তদন্তে ‘ফায়ারআই’-এর সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সহায়তাও নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ফায়ারআই ইনকরপোরেশনের তদন্তে এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে তদন্ত এখনো চলছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তরা বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে কিভাবে কাজ হয়, সে সম্পর্কে জানে। এ জন্য তারা হয়তো ব্যাংক কর্মকর্তাদের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক বলছে, বিশ্বের ২৫০টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানকে তারা সেবা দিচ্ছে। তাদের সিস্টেমে হ্যাকারদের ঢোকার কোনো সুযোগ নেই।
বিদেশি অর্থায়নে কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্পের পরামর্শক ব্যয় মেটানোসহ কিছু খাত দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে অর্থ ছাড় করেছে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরামর্শক ব্যয় ঋণদাতা সংস্থা সরাসরি পরিশোধ করতে পারে, আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও যেতে পারে। তবে এ ধরনের যেকোনো ব্যয় পরিশোধ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকের জানা থাকার কথা। কারণ প্রকল্পের যেকোনো ব্যয় তাঁর জ্ঞাতসারেই হয়ে থাকে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জালিয়াতির ক্ষেত্রে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে গোপনে নজর রাখছিল এবং তাদের ব্যক্তিগত কোড জেনে নিয়ে জালিয়াতি সম্পন্ন করেছিল।
দেশের আইটি বিশেষজ্ঞদেরও ধারণা অনেকটা এই রকম। তাঁরা বলছেন, গলদটা বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারেরই। হ্যাকাররা দেশের বাইরে থেকে এ সার্ভারের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নামেই অর্থ নিজেদের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের নির্দেশনা পাঠিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে। ফেডারেল রিজার্ভ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মনে করে তা পালন করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অর্থ চুরি যাওয়ার ঘটনা অনুসন্ধানে সহযোগিতার প্রস্তাব করেছে। এফবিআই ও ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের কর্মকর্তারা ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ এই ব্যাংক চুরির বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছেন।
গতকাল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা স্পর্শকাতর বিষয়টি তদন্তে করণীয় সম্পর্কে তাঁদের সহযোগিতা চেয়েছেন। বিশেষ করে হ্যাকিং সিস্টেম সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কললিস্ট চেয়েছে র্যাব।
জানতে চাইলে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আন্তর্জাতিক হ্যাকার বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করা কঠিন। অপরাধীদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়ার পাশাপাশি তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংককে সহযোগিতা করছে র্যাব।
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন