মিঠা পানির জলাভূমি ‘হাকালুকি হাওর’ ফেঞ্চুগঞ্জ (জিরো পয়েন্ট) এ বেড়িয়ে আসুন
২৪ মে ২০১৬, ১৭:৫১
হাকালুকি হাওড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানির জলাভূমি। পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড় ও পূর্বে পাথারিয়া মাধব পাহাড়বেষ্টিত হাকালুকি হাওড় সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ৫টি উপজেলায় বিস্তৃত। ছোট বড় প্রায় ২৩৮টির বেশী বিল ও ১০টি নদী নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওর বর্ষাকালে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় পরিণত হয়। হাকালুকি হাওড় পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নের জন্য একটি সম্ভাবনাময়ক্ষেত্র। এই হাওড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি।
হাকালুকি হাওড় বছরের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। শীত মৌসুমে হাওড়ের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। বিলের জলের মাঝে ও চারিধারে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিৎ উঁচুভূমি বিলের জলে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্য। শীতকালে হাওড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে সমৃদ্ধ করে বিভিন্ন ধরণের অতিথি পাখির আগমন ও কলরব। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অতিথি পাখিরা আসে এই হাকালুকি হাওরে খাদ্য ও আবাসস্থলের সন্ধানে। হাকালুকি হাওড় পরিণত হয় দেশীয় ও অতিথি পাখির মিলন কেন্দ্রে।
বর্ষাকালে হাকালুকি হাওড়ের ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদী একিভূত হয়ে রুপ ধারণ করে সাগরের ন্যায় এক বিশাল জলাশয়ের। এ সময় হাকালুকি হাওড়ের বিলের পাড় ও কান্দায় বিদ্যমান জলাভূমিবন পানির নিচে ডুবে গিয়ে সৃষ্টি করে ডুবন্ত বন যা ব্যবহৃত হয় মাছের আশ্রয়স্থল হিসাবে। বর্ষাকালে হাকালুকি হাওড় পাড়ে বসবাসরত মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় এক অন্যরকম উন্মাদনা। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাহন হিসাবে স্থান করে নেয় দেশীয় দাঁড়বাহী ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা। জেলেরা মেতে ওঠে মাছ ধরার উৎসবে। হাকালুকি হাওড়ের জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডারও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী পাওয়া যায় এই হাওড়ে। হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি, ১৪১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ১০৭ প্রজাতির মাছ দেখা যায়।
সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা হিসাবে পরিচিত সিলেট অঞ্চলের এ হাওড়টি দেশের অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। যা দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি হাওড়বাসীর জন্য বিকল্প আয় সৃষ্টি, হাওড়ের পরিবেশ উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। হাকালুকি হাওড় সরকার ঘোষিত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী এই হাওড়ে পরিবেশের প্রতি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন সব কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রচলিত ট্যুরিজমে যেহেতু অনেক ধরণের নেতিবাচক দিক রয়েছে তাই এই হাওড়ে পর্যটন শিল্পের বিকাশে ইকোট্যুরিজমের উন্নয়ন ও বিকাশ অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
হাকালুকির ইতিহাসঃ
“সাগর” শব্দটি থেকে “হাওর” শব্দের উৎপত্তি বলে ধরে নেয়া হয়। তবে “হাকালুকি” নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন লোককাহিনী রয়েছে। জনশ্রুতিমতে, বহু বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় এমনভাবে লুকি দেয় বা লুকিয়ে যায় যে, কালক্রমে ঐ এলাকার নাম হয় “হাঙ্গর লুকি”, ধীরে ধীরে তা “হাকালুকি”-তে পর্যবসিত হয়। আরেকটি জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচন্ড এক ভূমিকম্পে “আকা” নামে এক রাজা ও তাঁর রাজত্ব মাটির নিচে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় “আকালুকি” বা হাকালুকি। আরো প্রচলিত যে, এক সময় বড়লেখা থানার পশ্চিমাংশে “হেংকেল” নামে একটি উপজাতি বাস করতো। পরবর্তিতে এই “হেংকেলুকি” হাকালুকি নাম ধারণ করে। এও প্রচলিত যে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি একসময় বাস করতো কুকি, নাগা উপজাতিরা। তাঁদের নিজস্ব উপজাতীয় ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করা হয় “হাকালুকি”, যার অর্থ ‘লুকানো সম্পদ’।
যেভাবে যাবেনঃ
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে গ্রিনলাইন ও সোহাগ পরিবহনের ভলভোসহ সিলেটগামী যেকোনো বাস ধরতে পারেন। সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। এ ছাড়া কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন তিনটি ট্রেন পারাবত, জয়ন্তিকা ও উপবন সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। থাকবেন সিলেট শহরের যেকোনো হোটেল বা গেস্টহাউসে। কেননা, ফেঞ্চুগঞ্জে তেমন ভালো মানের হোটেল নেই। সিলেট থেকে সরাসরি বাস অথবা সিএনজি অটোরিকশাযোগে ফেঞ্চুগঞ্জে যাওয়া যায়। সেখান থেকে ঘিলাছড়া (জিরো পয়েন্ট) যেতে হবে শুধু সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। তবে সিলেট থেকে রিজার্ভ অটোরিকশায় সরাসরি ঘিলাছড়া যাওয়াই ভালো। দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। সময় লাগে ৪০ থেকে ৬০ মিনিট। যেতে হবে দুপুরের পর যেকোনো সময়। নৌকাভাড়া পড়বে ঘণ্টাপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন