সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হয়েছে : প্রধানমন্ত্রী
৩০ জুন ২০১৬, ১০:১০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিভিন্ন কার্যকর ও যথোপযুক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হয়েছে।
তিনি গতকাল সংসদে সরকারি দলের সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা পূর্বের মেয়াদে জনগণের অভূতপূর্ব রায় নিয়ে ৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ সরকার গঠন করে। এ গণরায়ের ভিত্তি ছিলো ‘রূপকল্প-২০২১’, দিন বদলের সনদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার কর্মসূচির প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন।
তিনি বলেন, যখন আমরা ২০০৯-এ সরকার গঠন করি সারা বিশ্ব ছিল তখন অর্থনৈতিক মন্দাগ্রন্ত। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও ছিল মন্দা কবলিত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার কর্মসূচি গ্রহণ করি।
তিনি বলেন, দেশকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা ও মজবুত করার লক্ষ্যে সামগ্রিক অর্থনীতির প্রধান বিষয় যেমন- মোট দেশজ আয়, প্রবৃদ্ধি, রফতানি আয়, কর্মসংস্থান, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি হ্রাসে আমরা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হই। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০১৫ সালের নমিনাল জিডিপি’র ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৬তম এবং ক্রয়ক্ষমতা সমতার জিডিপির ভিত্তিতে ৩৪তম স্থান অধিকার করেছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান পদক্ষেপ এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দীর্ঘমেয়াদী রূপকল্প হিসেবে ‘বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১)’ প্রণয়ন করে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ পরিকল্পনার লক্ষ্যসমূহ অর্জনে ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-১৫) বাস্তবায়িত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিগত সাত বছরে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, উন্নয়ন খাতে অর্থায়ন, অনুন্নয়ন খাতের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও ঋণ গ্রহণে ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষাসহ উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হয়। দেশজ আয় ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকার অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণকালে প্রবৃদ্ধি হার ছিল ৫.১ শতাংশ যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬.৫৫ এ উন্নীত হয়। ২০১৫-১৬ সালে প্রবৃদ্ধির হার ৭.০৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়ন বাজেটে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছি। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট ছিলো মাত্র ২৪ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৯১ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মত ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণ খাত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব ও কর রাজস্ব তিনগুণের অধিক হয়েছে। রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থাপনায় নেয়া বিভিন্ন প্রশাসনিক ও আইনি সংস্কার, জনবল বৃদ্ধি, অটোমেশন পদ্ধতি প্রবর্তন ইত্যাদি পদক্ষেপ রাজস্ব আহরণে বিশেষ অবদান রাখে। ২০০৯-১৫ মেয়াদে মোট রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক ১৭.৬৪ শতাংশ যা অতীতের যে কোন সময়ে চেয়ে বেশি।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশের ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগকে প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা ও বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার ফলে উৎপাদনশীলতা ও রফতানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিক জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে শিল্পের অংশিদারিত্ব বৃদ্ধি করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অধিক গুরুত্ব দেয়া এবং শিল্পখাতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানি-পরিবহনসহ ভৌত অবকাঠামো খাত উন্নয়নে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ক্রমশ ত্বরান্বিত করছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল ১০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ গুণ বেড়ে হয়েছে ৩২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তিনি বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি আমি ১০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছি। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা এবং বাংলাদেশের প্রধানতম শ্রম বাজারের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও সরকারের ঐকান্তিক প্রয়াসের ফলে দেশে ও বিদেশে মিলে গত সাত বছরে প্রায় ১০ কোটি ৬৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। এত কর্মসংস্থান অতীতে আর কখনও হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ছিল মাত্র ৪.৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫.২ মিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১৬ সালে ২৭ জুন ২৯.৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা এ যাবত কালে রেকর্ড।
শেখ হাসিনা বলেন, সরকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অনুকূলে টেকসই নিরাপদ ও মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে ১৩টি বৃহৎ সেতু নির্মাণ, ৩০ দশমিক ৫ কিলোমিটার নতুন সড়ক ও ৪ হাজার ৪৬ মিটার কংক্রিট সেতু নির্মাণ, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ, ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছ। ৭৫০ মিটার দীর্ঘ তিস্তা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৪ লেনে উন্নীতকরণ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে ফ্লাইওভার নির্মাণসহ উন্নযন কার্যক্রম বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ঢাকা শহরে একটি উড়াল রেল স্থাপনের বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নিকুঞ্জ-বনানী-মিরপুর-পূর্বাঞ্চল সংযুক্ত উড়াল সেতু, মগবাজার-মালিবাগ উড়াল সেতুসমূহ উন্ন্য়নের দৃশ্যমান মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। ২০১৮ সাল নাগাদ যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ১০টি অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প ফাস্ট ট্র্যাক ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো- পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ. ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট্, এলএনজি ফ্লুটিং, স্টোরেজ এন্ড রেজিসিফিকেশন ইউনিট নির্মাণ, মাতারবাড়ি ১ হাজার ২০০ মেঃ ওঃ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, পায়রা সমুদ্রবন্দর স্থাপন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন প্রকল্প।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্য নিরসন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য। সরকার রূপকল্প-২০২১ সামনে রেখে অগ্রসর হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ পেরিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, সুখী এবং উন্নত জনপদে পরিণত করার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১৪তে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্বের প্রথমসারির উন্নত দেশগুলোর সমপর্যায়ে উন্নীত করার রূপরেখা অঙ্কিত হয়েছে।
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন