বাংলাদেশের একটা মানুষ না খেয়ে থাকবে না, গৃহহীন থাকবে না : প্রধানমন্ত্রী
০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৮:২৬
চিলমারী, কুড়িগ্রাম, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করার দৃঢ় সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, বাংলাদেশের একটা মানুষও কষ্টে থাকবে না, একটা মানুষ না খেয়ে থাকবে না, একটা মানুষ গৃহহীন থাকবে না।
তাঁর দল জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্যই রাজনীতি করে, নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি দেশের মানুষের জন্য, নিজেদের জন্য নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে জনগণকে দিতে। আর অন্যরা ক্ষমতায় আসে নিতে, নিজেদের আখের গোছাতে।’
এ সময় সাম্প্র্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত চিলমারীর স্থানীয় গৃহহীন জনগণকে সরকারি উদ্যোগে ঘর-বাড়ি তৈরি করে দিতেও জেলা প্রশাসনকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ প্রদান করেন।
প্রধানমন্ত্রী আজ চিলমারীর থানা হাট এ.ইউ. উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আয়োজিত সূধী সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’- শীর্ষক স্লোগান নিয়ে হতদরিদ্র মানুষের জন্য চালু হওয়া এই পল্লী রেশনিং কার্যক্রমের আওতায় সারাদেশের ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়া হবে। পল্লী রেশনিং কার্ডধারীদের বছরে ৫ মাস দেয়া হবে এ খাদ্য সহায়তা। বছরের যে সময়ে ক্ষেতখামারে কাজ থাকে না এমন ৫ মাস যথাক্রমে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, মার্চ ও এপ্রিল-সরকারের এই খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চলবে। এই কর্মসূচি পরিচালনায় চলতি অর্থবছরে সরকারের এই খাতে ভর্তুকি লাগবে ২ হাজার ১শ কোটি টাকা। কুড়িগ্রাম জেলার নয় উপজেলার এক লাখ ২৫ হাজার ২৭৯ পরিবার এ সুবিধার আওতায় আসবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যাগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা খালেদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি এবং উপজেলা পরিষদেও চেয়ারম্যান শওকত হোসেন সরকার বীর বীক্রম। স্বাগত বক্তৃতা রাখেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব এএম বদরুদ্দোজা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। বিশ্বে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই কর্মসূচি সম্পর্কে বলেন, ‘ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাসে হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের কোনো কাজ থাকে না। কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও তাদের নেই। তাই এই তিন মাস তাদের জন্য কেজি প্রতি ১০ টাকা দরে চালের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
এছাড়া চৈত্র-বৈশাখ মাসেও এই দামে চাল পাবেন হতদরিদ্ররা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মঙ্গা-দুর্ভিক্ষ পীড়িত কুড়িগ্রামের অতীত স্মৃতিচারণ করে তাঁর সরকার মঙ্গা দূর করতে সমর্থ হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘আগে নীলফামারী ও চিলমারীতে দুর্ভিক্ষ ছিল। আমরা এসে তা দূর করেছি। এখন এই এলাকায় মঙ্গা বলে কোনো কথা শোনা যায় না, সে বদনাম আমরা ঘুচিয়েছি।’
কুড়িগ্রামসহ বৃহত্তর রংপুর এলাকায় উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলতে চাই, এ অঞ্চলে আর কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না, মঙ্গা হবে না কেউ না খেয়ে দুঃখে কষ্টে থাকবে না। পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী এক সময়কার চিলমারী বন্দর পুণঃস্থাপন করে নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে এর সঙ্গে পায়রা বন্দরের সংযোগ স্থাপন এবং অত্র এলাকায় দ্বিতীয় ধরলা সেতু, রেলসংযোগ স্থাপন সহ এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নে তাঁর সরকারের বৃহৎ কর্মপরিকল্পনাও তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দেখেছি, মানুষের কী অবস্থা, পায়ে স্যান্ডেল আছে কিনা, পেটে ভাত আছে কিনা, ঘর আছে কিনা। আমরা দরিদ্রদের জমি দেবো, ঘরবাড়ি দেবো। যারা ক্ষুধার্ত তাদের খাবার দেবো। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল, একদিন বাংলাদেশ উন্নত হবে, সমৃদ্ধশালী হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ২০২১ সালে আমরা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবো। ২০২১ সালে এ দেশ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রী ছিটমহল সমস্যার সমাধানে তাঁর সাফল্যের উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় এসে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেছি। এখন ছিটমহলবাসীর ঘর আছে কি না, খাদ্য, পোশাক আছে কি না, তার খোঁজ নিয়ে তাদের উন্নত জীবন ধারণের ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘ছিটমহলবাসীর চলাচলের রাস্তা, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, তাঁর সরকার ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে লড়াই করে বিশাল সমুদ্রসীমা জয় করেছে। আজ বাংলাদেশ বিশ্বে আধুনিক ও মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিএনপির সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, এ দলটি ক্ষমতার বাইরে গেলে ভারত বিরোধী আর ক্ষমতায় থাকলে ভারতপন্থী। ক্ষমতায় থাকতে দলটির নেত্রী (খালেদা জিয়া) ভারতে গিয়ে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন।
প্রকারান্তরে ভারতের মত দেশের কাছে নিজের দেশের জন্য ন্যায্য হিস্যা চাইবার মত সৎ সাহস তাদের ছিল না বলেও প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।
বিএনপি ক্ষমতায় এসে জনগণকে কী দিয়েছে- এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘তারা ক্ষমতায় আসে নিতে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে জনগণকে কিছু দিতে।’
সরকারের সামাজিক সুরক্ষা ও মানব উন্নয়নের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার একটা প্রতিজ্ঞা ছিল সুযোগ পেলে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর করার জন্য কাজ করব। তাতে জাতির পিতার আত্মা শান্তি পাবে। তিনি বেহেশতে থেকে দেখবেন, তার দুঃখী মানুষ আর দুঃখী নেই। পেটপুরে এখন খেতে পারছে।’
‘তার সেই চিন্তা থেকে আমরা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছি। আজকে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, ’বলেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি হতদরিদ্রদের সামনে এগিয়ে নিয়ে আসতে সরকারের অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমরা দুঃস্থদের সাহায্য দিচ্ছি। কিন্তু দুস্থ মানুষ, দুঃস্থ থাকুন- সেটা আমরা আর চাই না। সেটা থেকে মুক্তি মিলছে এখন। আমরা চাই দুস্থ শব্দটাকেই চিরতরে বিদেয় করে দিতে।’
দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়ায় বিএনপি-জামায়াতকে অভিযুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী নিজ নিজ সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখা এবং প্রত্যেকের সঙ্গেই অভিভাবকদের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি শিক্ষকদেরও তাদের শ্রেনীকক্ষের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে নজরদারির আহবান পুনর্ব্যক্ত করেন। যাতে কেউ আর জঙ্গিবাদের ভুল পথে যেতে না পারে।
তিনি বলেন, ‘সন্তানদের সঙ্গে অভিভাকদের সংযোগ বাড়াতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ক্লাসে অনুপস্থিত আছে কিনা? থাকলে কেন? সে ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে শিক্ষকদের।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা দেখেছেন, আগে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। বিএনপি-জামায়াতের সরকার মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করছিল। আমরা সরকার গঠন করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কঠোর হাতে দমন করি। কিন্তু কয়েকটি ঘটনা পর পর ঘটে যায়, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে মাত্র ১০ ঘণ্টার মধ্যে (গুলশানে হলি অর্টিজান বেকারীতে) আমরা জঙ্গি দমন করে জিম্মিদের উদ্ধার করেছি, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
ইসলামে মানুষকে খুন করতে বলা হয়নি। ইসলামসহ সব ধর্মে শান্তির কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুনের দায়িত্ব কিন্তু কাউকে দেওয়া হয়নি। বিচারের দায়িত্ব মহান আল্লাহর। তিনিই সবার বিচার করবেন। কাউকে হত্যা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না।
তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের মাধ্যমে ইসলামকে খাটো করা হয়। আমাদের ছেলে-মেয়েরা কম্পিউটার শিখবে। সবাইকে ভালোভাবে পড়াশুনা করে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এরআগে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টার যোগে সকাল পৌনে ১১টায় চিলমারীতে পৌঁছান। তাঁর এ আগমনক ঘিরে কুড়িগ্রামে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মূলত, সূধী সমাবেশ হলেও ভোর থেকে প্রধানমন্ত্রীকে এক নজর দেখার জন্য তাঁর কথা শোনার জন্য দূর- দুরান্ত থেকে দলে দলে মানুষ সুধী সমাবেশস্থলে এসে হাজির হয়। এক সময় স্কুল মযদান ছাপিয়ে আশপাশে বাড়ির ছাদ এবং সংলগ্ন সড়কের বহুদূর পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।