পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের কথা ভাবছে না বাংলাদেশ : প্রধানমন্ত্রী
০৩ অক্টোবর ২০১৬, ১০:০৭
ঢাকা, ৩ অক্টোবর, ২০১৬ : সমস্যা থাকলেও পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করার আভাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের বিষয় বাংলাদেশ ভাবছে না।
তিনি বলেন, ‘একটি দেশের সঙ্গে একটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকে। পাকিস্তানের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকবে, আবার ঝগড়াঝাটিও হবে।’
তিনি এ সময় ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনা এবং অভ্যন্তরীণ সংকটের বিষয়টি উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় মন্তব্য করে উদ্বেগও প্রকাশ করেন।
যুদ্ধারাধীদের বিচার প্রশ্নে পাকিস্তানের বিভিন্ন মন্তব্য এবং ভূমিকার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। আমরা মাথা উঁচু করে চলবো। পরাজিত শক্তি অনেক কিছুই বলতে পারে। তারা পরাজিত হয়েছে, তাই তারা বলবে। তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। কারণ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা করে যাচ্ছি।’
রোববার বিকেলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সাম্প্রতিক ১৭ দিনের কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সফর বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বিভিন্ন দিক তুলে ধরে নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।
তিনি বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ফলপ্রসূ আলোচনার বিষয়েও সংবাদ সম্মেলনে সবিস্তারে তুলে ধরেন।
তিনি এই সফরকে অত্যন্ত সফল ও ফলপ্রসূ উল্লেখ করে এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সফরে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও আইসিটি উপদেষ্টা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ কর্মসূচিতে মায়ের ছায়াসঙ্গী সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী মা হিসেবে গর্ব প্রকাশ করে সকলের কাছে তার জন্য দোয়া কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি স্যাঁতসেঁতে ঘরে চরম উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার পরিবেশে তার জন্ম। সে সময় একটি সুস্থ বাচ্চা যে আল্লাহতায়ালা আমাকে দিয়েছেন সে জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন।’
প্রধানমন্ত্রীকে এবার জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য নিউইয়র্কে অবস্থানকালে ‘প্লানেট ফিফটি ফিফটি চ্যাম্পিয়ন’ এবং গ্লোবাল পার্টনারশীপ ফোরাম ‘এজেন্ট অব দ্য চেঞ্জ’ পুরস্কারে ভূষিত করে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।
সফরের শেষ পাঁচদিন ওয়াশিংটনে পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে অবস্থাকালে প্রতিদিন ২ ঘন্টা করে অনলাইনে অফিস করে ৫১টি জরুরি ফাইল স্বাক্ষর করেন বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর কানাডা সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, কানাডায় গ্লোবাল ফান্ড সম্মেলনের ফাঁকে জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বৈঠক করি। বৈঠকে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দু’দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো সুসংহত করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানেরও প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা হয়। তিনি এ নিয়ে সে দেশের আইনি বাধার কথা উল্লেখ করেন। তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে কিভাবে স্পর্শকাতর ইস্যুটির সুরাহা করা যায়, তার উপায় খুঁজতে দু’দেশের উপযুক্ত প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা শুরুর পক্ষে মত দেন।
প্রধানমন্ত্রী জানান, তিনি জাস্টিন ট্রুডোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং ট্রুডো তা সানন্দে গ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেয়া প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিবারের মতো এবারো আমি বাংলায় ভাষণ দেই। ভাষণে অভিবাসী ও শরণার্থী ইস্যুটিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অনুরোধ করি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের পরামর্শদাতা, মূল পরিকল্পনাকারী, মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক, অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহকারী এবং প্রশিক্ষকদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাই।
ভাষণে শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বজুড়ে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বলেও জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আগত শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের কথা তুলে ধরেছি জাতিসংঘে। এ বিষয়ে আমরা একটি সমাধান চাই বলেও জানিয়েছি তাদের।
সংবাদ সম্মেলনে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জাবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা সত্যিই খুব উদ্বেগজনক। আমরা চাই না দুই দেশের মধ্যে এ সময়ে কোন রকম উত্তেজনা ও যুদ্ধ-বিগ্রহের সৃষ্টি হোক। এটা আমরা চাই না। এটা সব সময় মনে রাখতে হবে যে, এই ধরনের কোন ঘটনা যদি ঘটে তাহলে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আমাদের যে উন্নয়নের অগ্রযাত্রাটা শুরু হয়েছে, সেটা ব্যাহত হবে।’
দুই দেশের সীমান্তের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে যদি সার্কে আলোচনা করা না যায় তাহলে সার্কের প্রয়োজনটা কোথায়? প্রবীণ সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারের এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সার্ক যেহেতু একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং সার্কের চার্টারে আছে দ্বিপাক্ষিক কোন সমস্যা হলে সেটা এখানে আলোচনা করা যাবে না। যে কারণে বিভিন্ন মৌলিক বিষয়গুলোর এখানে আলোচনা করা হয় না- এটা ঠিক।’
তবে, সার্ক থাকবে কি থাকবে না, সেটা তাঁর এককভাবে বলতে পারার মতো কোন বিষয় নয়- মন্তব্য করে সার্কভুক্ত দেশগুলো এ বিষয়ে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর এই দেশগুলো নিয়ে জোট গঠনের প্রারম্ভিক চিন্তা-ভাবনা ছিল বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।
তিনি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, এই অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এর প্রয়োজন রয়েছে। তবে, এটিও ঠিক- সার্ক যেভাবে হয়ে গেছে বা সার্কের চার্টার যেভাবে হয়েছে তাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর কোন সমাধান হচ্ছে না- বা করা যাচ্ছে না। সমস্যাগুলোকে শুধুই কার্পেটের নিচে রেখে দেয়া হচ্ছে- এটাই বাস্তবতা। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিভাবে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারি তার একটি পথ ও পাথেয় খুঁজে বের করা উচিত বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে আরো বলেন, আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, এ অঞ্চলের জনগণের সমস্যাগুলো অনেকটা একই ধরনের। কাজেই এখানকার দরিদ্র জনগণের আর্থ-সমাজিক উন্নয়নে সামগ্রিক একটা কিছু চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এগুলোকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর একান্তই নিজস্ব উপলদ্ধি উল্লেখ করে সার্কের বিষযে এখনই কোন মন্তব্য বা মতামত প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই একমাত্র রাজনৈতিক দল যাদের নিয়মিত সম্মেলন হয়েছে উল্লেখ করে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের তৃণমূল পর্যায় থেকে আসা কাউন্সিলররাই দলের আগামী নেতৃত্বের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি বলেন, আর কারো কথা নয়- আমার কথা বলতে পারি, আমারতো এই সংগঠনের নেতৃত্বে ৩৫ বছর হয়ে গেছে। যদি আমাকে রিটায়ার করার সুযোগ দেয় তাহলে আমি খুশি হবো।
নেতৃত্বে না থাকলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাবার আকাংখা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমিতো দল ছেড়ে যাবো না। দলে থাকবো। তবে, তারা যদি নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেন তাহলে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবো। আর আমি যা করি তা কিন্তু সকলকে নিয়ে মতামতের ভিত্তিতেই করি।’
সম্মেলনটি আরো আগে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও ২২ ও ২৩ অক্টোবর এবারের পুনর্নির্ধারিত তারিখেই হবে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন, তারা এমন নির্বাচন কমিশন চায়, যারা ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি করবে। ১ কোটি ৩১ লাখ ভুয়া ভোটার বানাবে। তাদের ক্ষমতাকালে ভোটাধিকার ছিলো না। বরং মিরপুর, মাগুরায় ভুয়া ভোটাররা ভোট দিয়েছে, রমনা-তেজগাঁও আসনের নির্বাচনেও ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেনি। দেশবাসী এসব ভুলে যায়নি।
কানাডায় গ্লোবাল ফান্ড সম্মেলন এবং যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ ব্যস্ত সফরের পর ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে তিনি দেশে ফিরেন।-(বাসস)