হিলারিকে দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থ আটকেছিলেন ইউনূস :প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
২৬ জানুয়ারি ২০১৭, ০৯:২২
পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন আটকাতে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের যোগসাজশকে দায়ী করেছেন শেখ হাসিনা; এতে বাংলাদেশের এক সম্পাদকের ভূমিকার কথাও বলেছেন তিনি।
বুধবার জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব থেকে ইউনূসের বিদায়ের বিষয়ে কথা বলেন সরকার প্রধান।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মাঈদুল ইসলামের এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের দেশের কোন এক স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদক আর উনি (ইউনূস) মিলে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে… আমেরিকার ফরেন সেক্রেটারি হিলারি ক্লিনটনসহ এদের সকলের লবিংয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের টাকা দেওয়াটা বন্ধ করে দেওয়া হল।”
দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন আটকে দিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক। পরে বিশ্ব সংস্থাটিকে বাদ দিয়ে নিজেদের অর্থেই এই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৮ সালের মধ্যে এই সেতু খুলে দেওয়ার আশা করছে সরকার।
পদ্মা প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “উল্টো দুর্নীতির অভিযোগ আনা হল। যেখানে এক পয়সাও ছাড় হয়নি। বলা হলো দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে!”
গ্রামীণ ব্যাংকের পদ থেকে সরানোয় ক্ষিপ্ত হয়ে নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন ঠেকাতে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন বলে আগে থেকে বলে আসছেন শেখ হাসিনা।
পদ্মা প্রকল্প নিয়ে জটিলতারা আগে ২০১১ সালে বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনূসকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে আদালতে গিয়েও বিফল হন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, “আমরা কিন্তু উনাকে (ইউনুস) সরাইনি। তিনি মামলায় হেরে গেছেন।
“মামলা করার পরামর্শদাতা ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তার মেয়ে। উনি মামলায় হারলেন। আইনের কারণে উনার এমডি পদ চলে গেলে। এরপর উনি আমাদের ওপর ক্ষেপে গেলেন। সেই ক্ষ্যাপাটা পড়ল আমার পদ্মা সেতুর উপর।”
গ্রামীণ ব্যাংকের পদ হারানোর পর থেকে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে আওয়ামী লীগ নেতারাও দাবি করে আসছেন। এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পরাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ফাঁস হওয়া ই-মেইল দেখাচ্ছেন তারা, যেখানে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার তদ্বিরের বিষয় রয়েছে।
তবে ইউনূস বরাবরই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নাকচ করে আসছেন।
ই-মেইল ফাঁস নিয়ে হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও বিপাকে পড়েছিলেন। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তার হারের জন্যও এটাকে দায়ী করছে ডেমোক্রেট শিবির।
ইউনূসের জন্য হিলারির ফোন পাওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তার লবিস্ট আছে, এ আছে সে আছে। অনেক টাকা পয়সা খরচা.. অনেক বড় বড় জায়গা থেকে টেলিফোন, আর অনুরোধ।
“আমেরিকার হিলারি ক্লিনটন আমাকে ফোন দিলেন, তাকে এমডি পদ থেকে কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে। আমি বললাম, বাদ তো আমরা দিচ্ছি না। উনি মামলা করেছেন, মামলায় হেরে গেছেন। এখানে আমাদের তো কিছু করার নেই।”
“কোর্ট যে উনার থেকে অতিরিক্ত ১০ বছরের জন্য টাকা ফেরত চায়নি এটা বড় কথা,” বলেন শেখ হাসিনা।
‘চিটিংবাজ’
প্রশ্নোত্তরে গ্রামীণফোন নিয়ে কথা বলার সময় নোবেলজয়ী ইউনূসকে ‘চিটিংবাজ’ আখ্যায়িত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গ্রামীণফোনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, “উনি যে এই লবিংটা করল… সে সময় গ্রামীণফোনের লাইসেন্স আমার থেকে পেয়েছিল। উনার কাছে জিজ্ঞাসা করুন; এই লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আমাকে এক কাপ চা খাইয়েছেন? উল্টো আমি তাকে আমার অফিসে ডেকে চা খাইয়ে পরে ব্যবসা দিয়েছিলাম।”
জাতীয় পার্টির নেতা মাঈদুল ইসলাম সম্পূরক প্রশ্নে ইউনূসের ‘বিপুল’ সম্পদের উৎস নিয়ে সরকারি তদন্তের দাবি জানান।
এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউনূসের প্রতি সবার ‘দুর্বলতা ছিল’ বলেই তিনি যেভাবে চালান সেইভাবেই গ্রামীণ ব্যাংক চলছিল।
“ব্যাংকের আইন অনুযায়ী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এমডি থাকা যায়। কিন্তু, ওই এমডি যখন ৭০ বছর পার করেছেন .. তখনও তিনি এমপি ছিলেন। যার কারণে আমাদের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী ও আমার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তার কাছে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এমডি পদে আপনি আইনত থাকতে পারেন না। আপনাকে উপদেষ্টা এমিরেটাস হিসেবে আপনাকে সম্মান দেব। আপনি পদটি ছেড়ে দেন। কিন্তু, তিনি তা না মেনে কোর্টে গিয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করলেন।”
“আইনের কারণে তিনি এমডির পদ হারালেন, কিন্তু এর সম্পূর্ণ দোষ পড়ল আমার উপর। এখানে আমার কিছুই করার ছিল না।”
ইউনূস এমডির পদ হারানোর পর গ্রামীণ ব্যাংক যেন ভালোভাবে চলতে পারে, সেজন্য সুদের হার ৪০ থেকে ২৭ শতাংশে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
“আগে ঋণ দেওয়ার সাথে সাথে সাপ্তাহিক কিস্তির টাকাটা কেটে রেখে দেওয়া হত, এখন তা করা হয় না”
১৯৯৮ সালে বন্যার সময়ও কিস্তির টাকা আদায় করতে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীরা ঋণগ্রহীতাদের ঘরের টিনের চাল খুলে নিয়েছিল বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
“আমরা তখন তাকে (ইউনূস) বললাম, আপনি সুদ নিয়ে টানাটানি করবেন না, কোনো ক্ষতি হলে আমরা দেখব। পরে এজন্য আমরা প্রায় ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে চালিয়ে রাখার ব্যবস্থা করি।”
১৯৯৬ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর ইউনূস সরকারের কাছে মোবাইল ফোন চালুর প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
“উনি (ইউনুস) আমার কাছে গিয়ে বললেন, ‘একটি ফোন দিলে পরে এর থেকে যে লভ্যাংশ আসবে তা গ্রামীণ ব্যাংকে যাবে, সেখান থেকে সাধারণ মানুষ ঋণ সুবিধা পাবে। তখন গ্রামীণ ব্যাংকটা দাঁড়াবে’।
“উনার কথাটি আমি বিশ্বাস করলাম। আর গ্রামীণফোনের ব্যবসা আমরা তাকে দিলাম। গ্রামীণফোন টেন্ডারে তৃতীয় হওয়ায় তার এটা পাবার কথা নয়। তবুও আমরা তাকে দিলাম উনার কথায় বিশ্বাস করে।”
“অত্যন্ত দুঃখের বিষয় গ্রামীণফোনের যে শেয়ার বাংলাদেশের থাকার কথা, তার অধিকাংশ তিনি বিদেশে দিয়ে ওটাকে সম্পূর্ণ নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে নিয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকে গ্রামীণফোনের কোনো লভাংশ যায়নি। এটা চিটিংবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। রীতিমতো ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। এখন ওটা উনার নিজস্ব সম্পত্তি। এখন এটার ৩০ ভাগ মালিকানা নিজের হাতে রেখে বাকিটা উনি বেচে দিয়েছেন।”
ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে ইউনূসের তহবিল জোগানোর প্রসঙ্গ ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “শুনেছি কাকে, কোন ফাউন্ডেশনসহ এখানে-ওখানে টাকা দিয়েছেন। এখন উনার নতুন একটা ব্যবসা। উনাদের প্রচুর টাকা। এই টাকা গরিব-দুঃখী মানুষের ঘাম রক্ত ঝরিয়ে আয় করা টাকা। বিশাল অঙ্কের সুদ তুলে নিয়েছেন। কিন্তু ওই মানুষগুলোর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।”
হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় যশোরের ঋষিপল্লীতে ঋণ দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তার (হিলারি) হাত থেকে ওই ঋষিপল্লীর যাদেরকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তারা পরবর্তীতে ওখানে টিকে থাকতে পারেনি। দুটি পরিবার তো ওখান থেকে কোথায় হারিয়ে গেছে, তার খোঁজই পাওয়া যায়নি।”
নিজের জেলা গোপালগঞ্জেও গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সব হারানো পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কথা বলেন শেখ হাসিনা।
“একজন মহিলা পাঁচ হাজার টাকা লোন নিল, সেটা ১৬ হাজার টাকা হল। পরে আমি নিজে টাকা দিয়ে তার ঋণ শোধ করে ঋণমুক্ত করি।”
ইউনূস মামলা করে তার স্থায়ী আমানতের কর দিচ্ছেন না বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
“তার টাকা আছে প্রচুর। ট্যাক্স দেন না। মামলা করে রেখে দিয়েছেন। ট্যাক্স না দিয়ে ভালোই চলছেন।”
“কিছু কিছু মানুষ বোধ হয় ভাগ্য নিয়ে এই পৃথিবীতে আসে যে, তারা যত অন্যায় করুক না কেন, সেগুলোকে কেউ অন্যায় হিসেবে বিবেচনা করেন না। কিন্তু, আমাদের ক্ষেত্রে তিল পরিমাণ কিছু হলে বা পান থেকে চুন খসলে একবারেই বিশাল আকারে দেখানো হয়। কিন্তু, উনাদের ব্যাপারে তেমন কোনো শব্দ শোনা যায় না। জানি না, ওনাদের বাচনিক ভঙ্গী বা কার্যক্রমের মধ্যে কী ম্যাজিক আছে?”
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংক সুদমুক্ত; এটা সত্য। কিন্তু তার পাশাপাশি ৪০/৫০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো তো সুদমুক্ত নয়। সেইগুলোর ট্যাক্স কেন সরকারকে দেবে না? সেই রিপোর্টও এনবিআরের কাছে আছে।”
পাশে থাকা আবুল মাল আবদুল মুহিতের দিকে তাকিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “এখানে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আছেন। এটা তার দায়িত্ব। তিনি এটা দেখবেন। তিনি ব্যবস্থা নেবেন। আমি বলতে গেলে শুরু হবে নানা কথা।”
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন