বইমেলা খুঁজছে লেখকদের
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২২:০০
দেখতে দেখতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার সপ্তাহ পেরোলো। গতবারের বইমেলায় এমন দিনগুলোতে দর্শনার্থীদের টিকিটি খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। কারণ, ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ-হরতাল। পেট্রোল বোমার আঘাতে পোড়া মানুষের চিৎকার ও গন্ধে ভরে উঠেছিল রাজধানী। কিন্তু এবার একেবারেই ভিন্ন চিত্র। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকায় মেলার প্রথমদিন থেকেই মানুষের পদভারে মুখর হয়েছে বইমেলা প্রাঙ্গণ। ক্রেতা-পাঠকেরা এসে খুঁজছেন তাদের পছন্দের লেখককে। একটি অটোগ্রাফসহ বই কেনার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন ক্রেতারা। কিন্তু তারা পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত লেখককে!
বইমেলা শুরুর পর এ সাতদিনে জননন্দিত লেখকদের তেমন দেখা যায়নি। তবে প্রায় প্রতিদিনই এসেছেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। তিনি অটোগ্রাফ দিয়েছেন পাঠকদের। এছাড়া কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামকেও দেখা গিয়েছিল মেলা প্রাঙ্গণে। চ্যানেল আইয়ের বইমেলা প্রতিদিন অনুষ্ঠানে দেখা যায় বিশিষ্ট ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, বিটিভির এক অনুষ্ঠান সঞ্চালনে ব্যস্ত থাকেন বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক আলী ইমামকে। কিন্তু জননন্দিত লেখক সৈয়দ শামসুল হক, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, নির্মলেন্দু গুণসহ বড় বড় লেখকদের বইমেলায় দেখা যায়নি।
রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর উত্তরা থেকে এসেছিলেন গৃহবধূ আঁখি বেগম। সঙ্গে ছিল তার দুই ছেলেমেয়ে। তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা চেয়েছিল তাদের প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেবে। কিন্তু উনার দেখা পেলাম না। খুব খারাপ লাগছে।’
তবে রোববার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বইমেলায় এসেছিলেন কবি অসীম সাহা। মেলা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবারই বলছি প্রাণের মেলা। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় মেলা বিনোদনের জায়গা এসে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীতে বিনোদনের অনেক অভাব বলে অনেকেই মেলায় ছুটে আসেন। এখনও পর্যন্ত আমার কাছে ক্রেতার সংখ্যা কম বলেই মনে হলো। মেলার স্টল বিন্যাস ভালো হয়নি। এলোমেলোভাবে ছড়ানো-ছিটানো।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার মনে হয়, মেলা করার দায়িত্ব এখন বাংলা একাডেমির কাছে রাখা উচিত নয়। তাদের কাজ হচ্ছে গবেষণা করা। মেলার প্রস্তুতি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাদেরকে ব্যস্ত থাকতে হয় বছরের ৯ মাস। বাকি থাকলো ৩ মাস। এতে আর কী গবেষণা হবে?’
রোববার প্রকাশনা সংস্থা অবসর পৃথক পৃথকভাবে প্রকাশ করেছে ৫ খ্যাতিমান কবির ‘নির্বাচিত সেরা সাত’ শিরোনামের গ্রন্থ। লেখকেরা হলেন- শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, আহসান হাবীব ও নির্মলেন্দু গুণ।
বাংলা একাডেমির নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
বাংলা একাডেমি কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত ‘সালাহ্উদ্দীন আহমদ সংবর্ধনাগ্রন্থ’র মোড়ক উন্মোচন হয় বিকেল সাড়ে ৪টায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের হুমায়ূন আহমেদ চত্বরে। মোড়ক উন্মোচনে অংশ নেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক ড. গোলাম মুরশিদ।
মোড়ক উন্মোচন করে তারা বলেন, সালাহ্উদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন অনন্য ইতিহাসবিদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও প্রগতিশীল মূল্যবোধের একনিষ্ঠ সাধক। তার জীবদ্দশাতেই বাংলা একাডেমি তার কীর্তি মূল্যায়নমূলক সংবর্ধনাগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এই গ্রন্থের প্রস্তুতিকালে তিনি প্রয়াত হওয়ায় আমরা তার হাতে বইটি তুলে দিতে পারিনি। তবে যে ইতিহাসবোধ এবং অসাম্প্রদায়িক আধুনিক চেতনার উত্তরাধিকার তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাকে ধারণ করে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারবো। গ্রন্থটির সম্পাদনা করেছেন আনিসুজ্জামান, শামসুজ্জামান খান ও সিরাজুল ইসলাম।
এক সপ্তাহের পরিসংখ্যান
এবারের মেলার প্রথম সপ্তাহে নতুন বই এসেছে ৬৯২টি। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কবিতার বই এসেছে ১৫৯টি। এছাড়া উপন্যাস ১২৭, গল্প ১১৫, প্রবন্ধ ৪৩, গবেষণা ১০, ছড়া ২৫, শিশুতোষ ৩১, জীবনী ১১, রচনাবলী ১, মুক্তিযুদ্ধ ১৩, নাটক ১, বিজ্ঞান ১৩, ভ্রমণ ১১, ইতিহাস ১১, রাজনীতি ৪, স্বাস্থ্য ৫, কম্পিউটার ২, রম্য/ধাঁধা ৪, ধর্মীয় ৮, অনুবাদ ১, অভিধান ৬, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ৬ এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর এসেছে ৮৫টি।
নতুন বই
একাডেমির তথ্যানুযায়ী রোববার মেলার সপ্তম দিনে নতুন ১১৮টি বই এসেছে। এর মধ্য গল্প ১৪, উপন্যাস ২০, প্রবন্ধ ৮, কবিতা ৩৩, গবেষণা ৯, ছড়া ৩, শিশুসাহিত্য ৩, জীবনী ২, মুক্তিযুদ্ধ ৪, ভ্রমণ ২, ইতিহাস ২, রম্য/ধাঁধা ৪, ধর্মীয় ২, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ২ এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর বই এসেছে ১৯টি।
নতুন আসা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে শামসুর রাহমানের ’নির্বাচিত সেরা সাত’, আল মাহমুদের ‘নির্বাচিত সেরা সাত’, নির্মলেন্দু গুণের ‘নির্বাচিত সেরা সাত’ ও হরিশংকর জলদাসের ‘কসবি’, অবসর; যতীন সরকারের ‘সাকোঁ বাঁধার প্রত্যয়’ ও মুনতাসীর মামুনের ‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দুই’, কথা প্রকাশ; হাসান আজিজুল হকের ‘দ্য ফায়ার বার্ড’ ও শাকুর মজিদের ‘মাহিউবার গেন্দাকুল কিংবা ফৌজদারের হাটের মেরিগোল্ড’, পাঞ্জেরি; আখতার হোসেনের ‘ভোজের ভোজবাজি’, ময়ূরপঙ্খী; আলম তালুকদারের ‘ষোলো কোটির ভোট’ ও সাইদ হাসান দারার ‘উপাখ্যান : মুজিব ইয়াহিয়া ভুট্টো এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’, পারভেজ চৌধুরী অনূদিত ‘কানাডার সমকালীন কবিতা’, সময় প্রকাশন; পীযূষ বন্দোপাধ্যায়ের ‘ইটিং বিটিং’, বটেশ্বর বনণ; আমিনুর রহমান সম্পাদিত ‘পৃথিবী সেরা সমকালীন চার কবির কবিতা’, অ্যাডর্ন; আনিসুল হকের ‘গুড্ডুবুড়ার হাসির কাণ্ড গুড্ডুবুড়ার দারুণ কীর্তি’, ফরিদুর রেজা সাগরের ‘টেলিভিশনে ছোট কাকু’, অনন্যা; সুমন্ত আসলামের ‘বাউণ্ডুলে ১৫’ ও তৌহিদুর রহমানের ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’, পার্ল পাবলিকেশনস; ইজাজ আহ্মেদ মিলনের ‘কোনখানে রাখবো প্রণাম’, বিভাস।
সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নতুন বই
বইমেলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের একটি ব্যতিক্রমধর্ম বই প্রকাশিত হয়েছে। যার শিরোনাম ‘পবিত্র স্মৃতি : অ্যালবাম’। অনেকদিন ধরেই লিখছেন এ রাজনীতিক। এতদিন তার বিষয় ছিল রাজনৈতিক- আলেখ্য, ব্যক্তিত্ব বিকাশ, সমাজ ভাবনা ইত্যাদি। এবারের বইমেলায় বাংলাভাষী পাঠককে তিনি উপহার দিয়েছেন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি গ্রন্থ, যা সকল ধর্মপ্রাণ মানুষকে খুব করে নাড়া দেবে। বইটিতে স্থান পেয়েছে পবিত্র স্মৃতিঘর কাবার আলোকচিত্র, সঙ্গে কাবাঘর নির্মাণের ইতিহাসটিও। পাঠক গ্রন্থে পেয়ে যাবেন ‘নবি ইব্রাহিম (আ.)-এর পায়ের চিহ্নের ছবিটিও। আমাদের নবি (সা.)-এর স্মৃতি বিজড়িত অনেক দুর্লভ ছবিও এতে সংযোজিত হয়েছে, যা নবি (সা.)-এর প্রতি পাঠকের ভালোবাসায় এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
রোববার মূল মঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘অনুবাদ কার্যক্রম, অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট অনুবাদক অধ্যাপক আবদুস সেলিম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. নিয়াজ জামান, অধ্যাপক কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. ফকরুল আলম এবং অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন। সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশ করে গোলাম কুদ্দুছের পরিচালায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বহ্নিশিখা’-এর শিল্পীরা। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী লিলি ইসলাম, ফাহিমা হোসেন চৌধুরী, সাজেদ আকবর, সালমা আকবর, অণিমা রায়, শরীফ মো. সজীব।
সোমবার মূল মঞ্চের আয়োজন
সোমবার বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘পাঠ্যপুস্তক রচনা, অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সুব্রত বড়ুয়া। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন রতন সিদ্দিকী, মলয় ভৌমিক ও নূরুন্নাহার মুক্তা। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক অজয় রায়। এছাড়া প্রতিদিনকার মতো সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।